লকডাউন চলছে। বাজারে যাওয়া নিষেধ। সবজি নিয়ে জনাকয় ব্যাপারি দিনভরই ঘুরছেন পাড়ায়; অধিবাসীরা প্রয়োজনমতো ঝুলিয়ে দিচ্ছেন ব্যাগ; তুলে নিচ্ছেন জিনিস; নেমে আসছে টাকা; কিছু খারাপ সবজিও এর জেরে বিকিয়ে যাচ্ছে বটে; কিন্তু কী আর করা! এখন তো দেখে-বেছে কেনার উপায় নেই। সব ঠিকঠাক হয়ে বাজার পুরোদমে চালু হলে আবার নয় হবে জমিয়ে বাজারসফর।
অর্থাৎ, সবজি কেনার চলতি পদ্ধতি যে আবার ফিরবে, আমরা অন্তত এমনটাই ভাবছি। এখনই অন্য কোনো ব্যবস্থাকে নির্বিকল্প ভাবছি না। পাড়ায় সবজি বিক্রি আগেও ছিল, এখন বেড়েছে, দিনকয় বাদে আবার আগের মতো হয়ে যাবে। কিন্তু এটাই একমাত্র গৃহীত ব্যবস্থা হতে চলেছে, এরকম সম্ভাবনা অন্তত এখনও নেই। যাতায়াতের ক্ষেত্রেও যেমন ভাবছি, আবার বাস-ট্রেন, অটো-টোটো চালু হবে। কোনও বিকল্পের কল্পনা আমাদের ভাবনায় নেই। এই যে এখন অধিকাংশ অ্যাপার্টমেন্টে বাইরের লোক ঢোকা নিষেধ, এটিই যে পাকাপাকি ব্যবস্থা হবে, এমনটা অন্তত কেউ ভাবছেন না। অর্থাৎ, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, আবার গৃহসহায়িকারা আসবেন। মধ্যবিত্ত গেরস্থালির চলতি ব্যবস্থায় কোনো প্যারাডাইম শিফট হবে বলে, আপাতত ভাবা হচ্ছে না। এরকম বহু ক্ষেত্রেই আমরা পরিস্থিতি ঠিক হওয়ার অপেক্ষা করছি।
কেবল অপেক্ষা করছি না সিনেমা দেখা, গান-শোনা বা বই পড়ার ক্ষেত্রে। ইতোমধ্যেই এই ধারণা বেশ জোরালোভাবে প্রচারিত, এবং তা স্পষ্টত দৃশ্যমান যে, বিকল্প চাই-ই। বিকল্প খোঁজাই এখন নির্বিকল্প। বই, সিনেমা, গান যেন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে চলে আসবে এটি প্রায় আবশ্যিক সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে। এখন কেবল তার রূপায়ণটুকু বাকি।
এমন ভাবার কারণ নেই যে, অনলাইন প্ল্যাটফর্মের গুরুত্বকে খাটো করে দেখার বা দূরে সরিয়ে রাখার কোনো কারণ ঘটেছে। বরং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তা নিয়ে ভাবার প্রয়োজনীয়তা যে বেশি, তা অনস্বীকার্যও বটে। কোনো সময়ই সময়োচিত মাধ্যমকে অস্বীকার করার বোকামি করতে পারে না। ভাবনার জায়গা অন্যত্র। এই যে সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত এই বিশেষ কয়েকটি জিনিসের প্রচার, প্রদর্শন ও বিপণনের ক্ষেত্রে বিকল্প খোঁজাকে নির্বিকল্প করে তোলা হচ্ছে এবং যে দ্রুততায় তা করা হচ্ছে – এগুলো যদি চিহ্নক হয়ে থাকে, তবে চিহ্নিতটি কী? তা কি আমাদের ইঙ্গিত দিচ্ছে ব্যক্তির অধিকতর অপমৃত্যু এবং নয়া সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের!
এ-কথা আজ আর নতুন করে বলার নয় যে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের খুড়োর কলটি দেখিয়ে নয়া উদারবাদ সবার আগে কান মুলে দিয়েছে ব্যক্তিরই। ভুলিয়ে দিয়েছে তার প্রয়োজন। বদলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েই রচনা করেছে বিকল্প বাস্তবতা, যা প্রতিভাত হয়েছে প্রয়োজন হিসেবে। এই ছদ্ম প্রয়োজনের রাস্তা ধরেই বাজার তার কাজটি হাসিল করে গেছে যথাসময়ে। এখন, এই উদারবাদের মূলমন্ত্রই হচ্ছে, কোনও একটা কিছুকে নির্বিকল্প সাব্যস্ত করা। যখন কেউ জানবেন, সেটি ছাড়া তাঁর কাছে আর-কোনো বিকল্প নেই, তখন হাতের সামনে যে তিনটি জিনিস পাওয়া যায়, তার মধ্য থেকে একটা বেছে নেওয়াকেই তিনি তাঁর স্বাধীনতা বলে ভাবতে ভুল করবেন। এই ভুল ভাবিয়ে তোলার অনেকানেক অস্ত্রের মধ্যে মোক্ষমটি হল সংস্কৃতি। তা সরাসরি জবরদস্তি করে না। কিন্তু একজন ব্যক্তিকে চিন্তা-ভাবনার নিরিখে এমন একটা মানসিক অবস্থার মধ্যে রেখে দেয়, যে, সে তার বাইরে কিছু ভাবতে বা বেছে নিতে ভুলে যায়। এমনকি এই গণ্ডির বাইরে কিছু মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়া এমনকি সহ্য করারও ক্ষমতাও সে হারিয়ে ফেলে। এই অবস্থাকে চমৎকারভাবে যে কাজে লাগাতে পারে, সে রাজনীতি। আধিপত্য বিস্তারে তাকে আর বিশেষ কষ্ট করতে হয় না, কারণ যাদের উপর এই আধিপত্য তারা তা মেনে নিতে প্রস্তুতই থাকে।
এসবই দস্তুর হয়ে উঠেছে বহুদিন এবং মহামারীর আগেকার চলতি ব্যবস্থা যে এর বাইরে, তা বলা যায় না। এখন সম্ভবত তার-ই আর-একটি ঘন-সংঘবদ্ধ রূপের দিকেই এগিয়ে চলেছি আমরা। সবজির উদাহরণে ফিরে যাই যদি, দেখব, বাজারে যা আসে তাই-ই আমাদের কিনতে হয় বটে, তবু কিছু বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকে। পাড়ায় যা আসে এবং যা ব্যাপারী মেপে ব্যাগে করে দড়িতে ঝুলিয় দিচ্ছে সেখানে আর বাছার প্রশ্নই থাকছে না। উপরন্তু মহামারী এবং লকডাউন; সুতরাং ক্রেতা বা ভোক্তা এটা মেনে নিচ্ছেন যে, এ ছাড়া আর উপায় কী! তবুও তো হাতের সামনে পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ, সেই নির্বিকল্পের সূত্র।
ঠিক একইভাবে, আমাদের হাতের সামনে এসে গেল কিছু কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম; হয়তো আরও আসবে; সেখানে কোনোটায় সিনেমা থাকবে, কোথাও গান, কোথাও বই। সংখ্যায় যথেষ্টই থাকবে, যাতে ওই বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা নামক ভ্রান্তিটিকে জারিয়ে রাখা যায়। কিন্তু ঘটনা হল, আসলে ‘ব্যক্তির স্বাধীনতা’র মিথ্যে পরিসরটিকেই আরও দৃঢ়ভাবে মিথ্যে ও সংকুচিত করা হল। একটা প্ল্যাটফর্মে ১০টি সিনেমা যদি থাকে, একজন ক্রেতা অনেক বেছে তার থেকে একটিই দেখলেন হয়তো; কিন্তু সেটাও হয়তো তাঁর দেখার কথা ছিল না। অন্য অবস্থায়, তিনি এমন একটি ছবি দেখতেন হয়তো-বা, যা তাঁর মননকে আমূল বদলে দিত। সে-সুযোগ এখানে না-মেলার সম্ভাবনাই বেশি; কারণ তা গরিষ্ঠসংখ্যক ভোক্তার কথা মাথায় রেখে বিষয়বস্তুর একটি সাধারণ মান নির্ণয় করে চলাকেই ঠিক মনে করবে; বিনিময়ে আরও বহুসংখ্যক মানুষের ভাবনাকে বেঁধে ফেলতে পারবে সাধারণ মানের পরিসীমায়। একইভাবে এখানে, ১০টি বইয়ের মধ্যে তিনি হয়তো একটি বই-ই পড়বেন, কিন্তু হয়তো তার বাইরের কোনো বই-ই তিনি পড়তেন; যদি বৃত্তটিকে ছোটো করে চোখে আঙুল দেওয়ার অহরহ প্রয়াস না-থাকত।
ব্যক্তির এই সংকট চলতি ব্যবস্থাতেও ছিল; পাশাপাশি এই বিকল্প ব্যবস্থাও ছিল; কিন্তু এ দুইয়ের মধ্যে নয় নয় করেও একটি পরিসর ছিল, যা এই মহামারী পরবর্তী ভাবনা এসে অতি দ্রুত মুছে দিচ্ছে। সে সার্থকভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে নির্বিকল্প সূত্র। যেখানে ফিজিক্যাল ডিস্ট্যান্স মেনে চলতে হবে আরও বহু বহু দিন, সেখানে জমায়েতের সম্ভাবনা ক্ষীণপ্রায়; অর্থাৎ কিনা পরিস্থিতিই এই যে, সিনেমা দেখতে হলে কি বই পড়তে হলে অনলাইন ছাড়া গতি নেই। সিনেমার প্রযোজক বইয়ের প্রকাশকরাও বাধ্যত সে পথে হাঁটবেন। পরিচালক, লেখকরাও তা ছাড়া উপায় দেখবেন না। দেখা যাচ্ছে, ওয়েব সিরিজ কী করে লিখতে হয়, তা এখন আলাদা করে শেখানো হচ্ছে। শুধু চিত্রনাট্য নয় কিন্তু; ওয়েব সিরিজ; তার দর্শক আলাদা, প্ল্যাটফর্ম আলাদা ফলত ট্রিটমেন্টও আলাদা। এই প্ল্যাটফর্ম অবশ্যই বলবে, আপনার ইচ্ছে না-করলে যে-কোনো সময় এখান থেকে বেরিয়ে যাবেন। কিন্তু আসলে যে আপনি কখনও তা থেকে বেরোবেন না, তা তাঁরা ভালোই জানেন।
সময়ের চাহিদায় বিকল্প আসবে, তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অস্বাভাবিক এই যে, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেই এই বিকল্প আনার দ্রুততা, বস্তুত সময়কে স্বীকার করে নেওয়ার বাইরেও অন্য কিছুর ইঙ্গিত দেয়, যা অস্বস্তির। হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে যে অযুত ‘জ্ঞানরাশি’ অহরহ প্রচারিত হচ্ছে, তার যে কী বিষময় ফল, তা আমরা হাড়েমজ্জায় টের পাচ্ছি। রভিশ কুমার বলেন, এ হচ্ছে ‘জ্ঞানের হোম ডেলিভারি’। একেবারে ব্যক্তিগত বার্তার মতো স্বল্পকথায় সে এসে হাজির হচ্ছে আমাদের করতলে। আর, যেখানে অভিজ্ঞান–অঙ্গুরীয় নেই, শিক্ষা ও যুক্তির অভাব বিসদৃশভাবে প্রকট, সেখানে সেই ‘জ্ঞান’কেই প্রায় ধ্রুব বলে মনে হচ্ছে; পারসেপশন তৈরি হচ্ছে; ছোটো ছোটো বদ্ধ পৃথিবী এমনভাবে গড়ে উঠছে যে, একের সঙ্গে অন্যের হাওয়া চলাচলই অসম্ভবপ্রায়। এর রাজনৈতিক ফয়দা যে ঠিক কীভাবে উঠতে পারে, গত কয়েক বছরে পৃথিবীর দিকে তাকালেই তা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়। এই অনলাইন প্ল্যাটফর্মের বিকল্প ব্যবস্থাও কি সেই সংকীর্ণ পৃথিবীর প্রজন্ম তৈরি করার ক্ষেত্রে বাড়তি গতি আনবে না!
ব্যক্তিগত অভিরুচি অবশ্য চিরকালই প্রত্যেকের জন্য পৃথক। কিন্তু এই রুচিবোধের নির্মাণ একটা সামগ্রিক প্রক্রিয়া। সামাজিক ও রাজনৈতিক অবশ্যই। সেটিই যখন কেবলমাত্র একাকীর হয়ে উঠবে, তখন তা ওই অজস্র ছোটো পৃথিবীরই জন্ম দেবে, যারা একদিন হয়তো ভুলে যাবে যে, আসলে পৃথিবী একটাই। সেটা সকলের; এই সেদিনও একটা ঠিক-ভুল বই পড়লে চেনাজানা কেউ দু-কথা বলতে পারতেন; পরামর্শ দিতেন। ছবি দেখতে হলে যেতে গেলেও একধরনের অনুমোদনের প্রয়োজন হত। এক্ষেত্রে আর তা থাকবে না। মনে হবে, সেটিই ব্যক্তির চূড়ান্ত স্বাধীনতা। কিন্তু তাই কি তার দ্রুত অপমৃত্যু নয়! তাহলে, যা ব্যক্তিও নয় এবং যার হাত ধরে সমষ্টির কাছে পৌঁছনোর প্রশ্নই ওঠে না, সে আসলে কী? কেবলমাত্র সার্থক উপনিবেশ গঠনের ভূমি মাত্র! নয়া উদারবাদ কি তবে ভাবনাজগতের ভবিষ্যৎ লকডাউন দীর্ঘস্থায়ী করতেই মহামারীকে নিমিত্ত করে সংস্কৃতি জগতে বিকল্পের ভাবনাকে নির্বিকল্প করে তুলতে উঠেপড়ে লেগেছে? নইলে অন্য অনেক কিছুকেই যখন আমরা সাময়িক বলে ধরে নিয়েছি, ফিরে যেতে চাইছি পুরনো ব্যবস্থায়, তখন শুধু বইপড়া বা সিনেমা কি গান শোনার ক্ষেত্রেই এত বিকল্পের খোঁজ কেন? এই প্রশ্নচিহ্ন ধরে আমাদের নিশ্চিতই ভাবনার অবকাশ থেকে যাচ্ছে; যা অস্বীকার করার উপায় আমাদের সত্যিই নেই।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)