হিন্দুদের পাঠশালায় প্রবেশ নিষেধ, মাদ্রাসাতেই পড়াশোনা মতুয়া ধর্মগুরুর!

নমঃশূদ্র পরিবারে জন্ম তাঁর। কিন্তু ছোটোবেলা থেকেই আগ্রহ পড়াশোনার প্রতি। প্রতিবেশিরা তো রীতিমতো ছিছিক্কার ফেলে দিয়েছে। সাত প্রজন্মে কেউ কোনোদিন পাঠশালার মুখ দেখেনি, সে নাকি পড়াশোনা করবে? আর করতে চাইলেই বা তা সম্ভব কী করে? 'চণ্ডাল’রা কি পাঠশালায় যায়? যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন দেশে রীতিমতো ব্রিটিশ রাজত্ব কায়েম হয়ে গিয়েছে। আধুনিক শিক্ষার একটা ধারাও শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও নিম্নবর্ণের হিন্দুরা তখনও ব্রাত্য। আসলে প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি বলতে তখনও পাঠশালা। আর সেখানেই বঞ্চিত ‘চণ্ডাল’রা।

তবে ফরিদপুরের সাফলিডাঙা গ্রামের হরিচাঁদ ঠাকুর কিন্তু সংকল্প করলেন, ছেলের পড়াশোনার ইচ্ছা তিনি মেটাবেন। কিন্তু সমাজ তা মেনে নেবে কেন? না, কোনো পাঠশালাতেই জায়গা হল না গুরুচাঁদ ঠাকুরের। শেষ পর্যন্ত গুরুচাঁদ পড়াশোনা শুরু করলেন। তবে পাঠশালায় নয়। তিনি ভর্তি হলেন মাদ্রাসায়। সেখানে বর্ণের ভেদ নেই। কিন্তু হিন্দুর ছেলে কিনা পড়াশোনা করবে মুসলমানদের মাদ্রাসায়? আর ‘চণ্ডাল’দের হিন্দু বলে তো স্বীকার করা হয়নি কোনোদিনই। ছিল না মন্দিরে প্রবেশের অধিকারও। কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যাওয়ার অধিকার ছিল না। সবেতেই তাঁরা ব্রাত্য। কিন্তু তাঁদের শ্রম ব্রাত্য নয়। সেই শ্রমের উপরেই দাঁড়িয়ে ছিল ব্রাহ্মণ্যধর্মের কাঠামো।

গুরুচাঁদ ঠাকুরের মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়া নিয়ে মুসলমান সমাজেরও কেউ কেউ আপত্তি তুলেছিলেন। কিন্তু হিন্দুদের কঠোর বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার কাছে সেই আপত্তি ছিল নেহাতই মৃদু। গুরুচাঁদ ঠাকুরের পড়াশোনা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল এক ইতিহাস। সেই ইতিহাস কোনো ব্যক্তির জীবনের নয়। বরং বাংলার গ্রামাঞ্চলের ‘চণ্ডাল’ মানুষদের উঠে দাঁড়ানোর ইতিহাস। ভাবতে অবাক লাগে, একজন মানুষ তাঁর ৯০ বছরের জীবনে ১৮১২টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। আর প্রতিটি স্কুলের মূল লক্ষ্য ছিল নিম্নবর্ণের মানুষদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া।

পিতা হরিচাঁদ ঠাকুরের হাত ধরেই বাংলায় মতুয়া ধর্ম আন্দোলনের শুরু। গুরুচাঁদ ঠাকুর সেই আন্দোলনকেই অধিক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৮৮০ সালে ওড়িয়াকান্দিতে প্রথম বিদ্যালয় স্থাপন করেন গুরুচাঁদ ঠাকুর। ‘চণ্ডালে’র উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্কুল, সেখানে ‘চণ্ডাল’দের পড়াশোনার অবাধ অধিকার। শিক্ষিত বর্ণবাদী হিন্দুদের প্রত্যেকেই বিরোধিতায় নামলেন। কিন্তু কোনোভাবেই গুরুচাঁদ ঠাকুরের সংকল্প তাঁরা ভাঙতে পারলেন না। ১৮ বছরের মধ্যে ওড়িয়াকান্দি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত হল। এরপর বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে ঘুরে ঘুরে নিম্নবর্ণের মানুষদের একজোট করে স্কুল তৈরি করতে থাকলেন গুরুচাঁদ ঠাকুর। তিনি বুঝেছিলেন, আজকের দিনে মাথা উঁচু করে বাঁচতে গেলে সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষা।

আরও পড়ুন
মার্চেই বন্ধ হচ্ছে টেকিপ, অনিশ্চয়তার মুখে দেশের কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা

১৮৮১ সালে তাঁর উদ্যোগেই খুলনার দত্তভাঙায় নমঃশূদ্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ‘চণ্ডাল’ নয়, তাঁরা নিজেদের পরিচয় চান নমঃশূদ্র নামে। এই নমঃশূদ্র আন্দোলনের চাপেই ব্রিটিশ সরকার জনগণনার তালিকা থেকে ‘চণ্ডাল’ শব্দটি বাদ দেয়। সেটা ১৯১১ সাল। বর্ণবিভাজনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মতুয়া আন্দোলন এক কিংবদন্তি। আজও তাকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে ছাড়েন না নানা দলের নেতা-নেত্রীরা। তবে তার মধ্যে প্রতিশ্রুতিই সার। প্রকৃত ইতিহাসের অনুরণন নেই বললেই চলে।

আরও পড়ুন
মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ পান না বিশ্বের ৪০ শতাংশ মানুষ, জানাল ইউনেস্কো

তথ্যসূত্রঃ বাংলার ইতিহাসে হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুর ঠাকুরের আবদান, ফিলোজফিবিডি
ওড়াকান্দির মহাবারুনীর মেলা, জাগরণ
বাংলার অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠীর চন্ডালত্ব মোচনে ঠাকুর বংশের অবদান, অভিজিৎ পান্ডে, দি নিউজ
বাংলার গর্ব গুরুচাঁদ ঠাকুর, বার্তা টুডে
উইকিপেডিয়া

আরও পড়ুন
৭০ বছর ধরে গ্রামের দরিদ্রদের শিক্ষাদান, পদ্মশ্রী পেলেন শতায়ু নন্দ প্রুস্তি

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More