লাতিন আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের দেশ ইকুয়েডর। একদিকে সমুদ্র, অন্যদিকে আমাজন (Amazon)। আর সেই অরণ্যেই বসবাস কোফান নামের এক আদিবাসী জনজাতির। বিশ্বের বিভিন্ন প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মতোই কোফানরাও রয়েছে সম্ভাব্য অবলুপ্তির তালিকায়। এই সম্প্রদায়ের বহু মানুষ আমাজনের ‘প্রাচীন’ জীবনযাপন ছেড়ে বাসা বেঁধেছে শহরে। কাজেই কমতে কমতে বর্তমানে তাদের জনসংখ্যা ঠেকেছে আড়াইশোতে। তবুও নজির গড়ল তাদের হার না মানা লড়াই। ছোট্ট এই জনগোষ্ঠীর সামনেই বশ্যতা মানতে বাধ্য হল কোটিপতি স্বর্ণখনির মালিক, এমনকি ইকুয়েডরের (Ecuador) সরকারও। প্রাণ বাঁচল প্রকৃতির।
শুরু থেকেই বলা যাক ঘটনাটা। ২০১৭ সাল। আর পাঁচটা দিনের মতোই শুরু হয়েছিল দিনটা। কেউ যাচ্ছেন ফসল বুনতে। কেউ আবার শিকারের যাওয়ার জন্য শান দিচ্ছেন অস্ত্রে, বাঁধছেন ধনুকের ছিলা। এমন সময় এক্সক্যাভেটর, বুলডোজার, রোটেটিং ক্র্যাব-সহ ভারি ভারি খননের যন্ত্রপাতি নিয়ে হাজির হয় একদল শহুরে মানুষ। ব্যাপার কী? কথা বলায় জানা যায়, যে অরণ্য তাদের বাসস্থান, পবিত্র ভূমি— সেখানেই নাকি শুরু হবে স্বর্ণখনন। জড়িয়ে রয়েছে সে-দেশের বেশ কয়েকটি বড়ো বড়ো স্বর্ণবিপণি সংস্থা। রাষ্ট্রেরও হাত রয়েছে তাতে। সবমিলিয়ে ২০টি বড়ো মাপের স্বর্ণখনির খননের অনুমতি ছিয়েছে ইকুয়েডর সরকার। তাছাড়া আরও ৩২টি খনি খননের ছাড়পত্র আসতে চলেছে কিছুদিনের মধ্যেই। আর তার জন্যই কাটা হবে গাছ। ভাঙা হবে আদিবাসীদের ঘর-বাড়িও।
আশ্চর্যের বিষয় হল, কোফানদের বাসস্থানে যে খনন শুরু হবে, সে ব্যাপারে কোনো তথ্যই আগে থেকে জানানো হয়নি তাঁদের। নেওয়া হয়নি তাদের মতামতও। না, চুপ করে থাকেনি কোফানরা। শুরু হয়েছিল আন্দোলন। অবশ্য মাত্র ২৫০ জন মানুষের পক্ষে দেশের তাবড় গোল্ড-মাফিয়াদের সঙ্গে কি পেরে ওঠা যায়?
সমস্যার সমাধান খুঁজতে এগিয়ে আসেন দুই তরুণ কোফান নেতা— অ্যালেক্স লুসিটান্ট এবং আলেকজান্দ্রা নারভেজ। সরকার এবং স্বর্ণখাদানকারীদের এই তাণ্ডব ঠেকাতে প্রযুক্তির সাহায্য নেন তাঁরা। শহরে গিয়ে কিনে আনেন ড্রোন ক্যামেরা। তা দিয়েই তাঁরা রেকর্ড করেছিলেন আমাজনের এই ধ্বংসলীলার ছবি, ভিডিও। তারপর হাজির হয়েছিলেন ইকুয়েডরের আদলতে। অরণ্য সংরক্ষণ এবং আদিবাসী জনজাতি অধিকারের ভিত্তিতে মামলা ঠুকেছিলেন খোদ ইকুয়েডর সরকারের বিরুদ্ধে।
দীর্ঘ ৫ বছর পর সম্প্রতি নিষ্পত্তি হল সেই মামলার। জয় পেল কোফানরা। সংশ্লিষ্ট খনিগুলি বন্ধ করা হয়েছে তো বটেই, পাশাপাশি আগামীতে আমাজনের ১৫০০ বর্গমাইল অঞ্চলে কোনো খনি খনন করা যাবে না বলেই জানিয়েছে আদালত। কাজেই এই জয় শুধু কোফানদের নয়, বরং ইকুয়েডরের সমস্ত আদিবাসী জনগোষ্ঠীদেরই। দুই তরুণ কোফান নেতার এই লড়াই যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে ইজরায়েলের সেই প্রাচীন গল্প— ডেভিড এবং গোলিয়াথের কাহিনিকেই…
Powered by Froala Editor