অভিজিতের 'স্ত্রী' নন, নোবেল পেয়েছেন 'অর্থনীতিবিদ' এস্থার ডুফলো

ভালোবাসেন সমুদ্রসৈকতে ঘুরতে যেতে। রান্নাও নেহাৎ অপছন্দ নয় তাঁর। কিন্তু যে রাঁধে, সে তো চুলও বাঁধে! কিন্তু এক্ষেত্রে রান্নার থেকে বেশি প্রিয় নিজের কাজই। তাই অনায়াসেই অর্থনীতি নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারেন বছরের পর বছর। শুধু তাই নয়, কাজের জোরে পেয়ে যান নোবেলও। এস্থার ডুফলো। ফ্রান্সের প্রথম ও বিশ্বে দ্বিতীয় মহিলা হিসেবে অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন তিনি। আর এই বিভাগে কনিষ্ঠতম হিসেবে নোবেল পাওয়ার শিরোপাও তাঁরই।

আরও পড়ুন
এক শহর, ৬ নোবেল-প্রাপক - কল্লোলিনী কলকাতার গল্প এমনই

এ-বছর অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, এস্থার ডুফলো এবং মাইকেল ক্রেমার। ঘটনাচক্রে অভিজিৎ আর এস্থার সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী। আর তাতেই একধরণের মন্তব্য ঘোরাফেরা করছে বাঙালি মহলে। ‘অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নোবেল পেলেন তাঁর স্ত্রী এস্থার ডুফলো-ও।’ অথচ এস্থার নোবেল পেয়েছেন স্বতন্ত্র অর্থনীতিবিদ হিসেবেই। অভিজিৎবাবুর স্ত্রী তিনি – নোবেলপ্রাপ্তির পিছনে এই সামাজিক পরিচয়ের কোনো ভূমিকাই নেই।

মিতবাক ও স্বভাব-গম্ভীর এস্থার ডুফলো বক্তৃতার শুরুতেই নিজের সম্পর্কে বলে ফেলেন তিনি বেঁটে, উচ্চারণে ফরাসি টান আছে তাঁর। এটা কি তাঁর অভিমান, নাকি সমাজের একটা দৈন্য মানসিকতার প্রতি ঠাসিয়ে থাপ্পড়?  তাঁরও একটা উড়ান আছে নিজস্ব। যখন অর্থনীতি নিয়ে ভাবেন না তখন ভালোবাসেন রক ক্লাইম্বিং। তাঁর সোজাসাপ্টা উক্তি, ‘যদি ভাবো ওঠাটা কঠিন, তা হলে ওঠাটা কঠিনই হয়ে উঠবে। ওঠার জন্য মরিয়া চেষ্টা যেমন থাকতে হবে, তেমনি ধৈর্য ধরতে হবে, আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে যে, আমি চূড়ায় উঠতে পারব।’ যা হয়তো শুধু রক ক্লাইম্বিং নয়, জীবনের ক্লাইম্বিং-এরও মর্ম ভেদ করে যায়। সমুদ্রসৈকত তাঁর কাছে একমনে ইকোনোমিকস বই পড়ার রসদ বলেই মনে হয়। এস্থারের ভাই দর্শনের, বাবা গণিতের অধ্যাপক। মা ডাক্তার। পরিবারে সবাই একই সঙ্গে ডিনারে বসলে তা হয়ে ওঠে বিভিন্ন মতের ও বিষয়ের তুখোড় আলোচনা ও তর্কের পীঠস্থান। অবসর সময়ে ধ্রুপদী সঙ্গীত শোনা তাঁর অন্যতম প্রিয় বিষয়। এককথায়, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের দিক দিয়েও তিনি উজ্জ্বল।

প্যারিসে 'একল নর্ম্যাল সপোরিয়র' থেকে অর্থনীতি ও ইতিহাসে একসঙ্গে ডিগ্রির পর ১৯৯৯ সালে ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি (MIT) থেকে প্রফেসর অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে পিএইচডি সম্পন্ন করেন তিনি। ২৭ বছর বয়সে MIT অধ্যাপক হিসেবে কেরিয়ার শুরু করেন এবং প্রফেসর অভিজিৎ ববন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলে গড়ে তোলেন 'আব্দুল লতিফ জামিল পোভার্টি একশন ল্যাব’। তাঁর কাজ মূলত ডেভেলপমেন্ট ইকোনোমিকস নিয়ে। এই কাজের জন্য তাঁকে ২০১১-২০১২ সালের মধ্যে অনেকবারই আসতে হয়েছে উত্তর ভারতের প্রান্তিক বিভিন্ন জায়গায়। তাঁর ফিল্ড স্টাডির অন্যতম ক্ষেত্র ছিল ভারত ও আফ্রিকা।

বাঙালি হিসেবে আমরা অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেলপ্রাপ্তি নিয়ে গর্বিত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সে-বিষয়ে অতিরিক্ত উচ্ছ্বাসও স্বাভাবিক। কিন্তু এই উচ্ছ্বাসের বশে এস্থারের সাফল্যকে কোথাও ছোট করে দেখছি না তো আমরা? ‘অভিজিৎবাবুর স্ত্রী’ – এই পরিচয়ে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন না তো নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ? পাশাপাশি কেউ কেউ এই মন্তব্যও করছেন, বিদেশি স্ত্রী হওয়ার দৌলতেই নোবেলপ্রাপ্তি অভিজিৎবাবুর। এসব সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে আর কবে বেরিয়ে আসব আমরা? ব্যক্তিগত সম্পর্ক যে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সম্মান প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকাই রাখে না, এটা বোঝার মতো পরিণত হওয়া প্রয়োজন এই জাতির। শীঘ্রই। নইলে দীর্ঘদিন অন্তর এমন একেকটি নোবেলপ্রাপ্তিতে সাময়িক উচ্ছ্বাসই ভেসে উঠবে, অভ্যাসে পরিণত হবে না এই অর্জন।