পুলিশের লাঠি, ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ও এক ‘গোঁড়া’ সমর্থকের কিস্‌সা

আকাশবাণীর সামনে পৌঁছোতেই খেয়াল করলাম লেসলি ক্লডিয়াসের মুখ থেকে শুরু হয়েছে জমায়েত। কয়েকশো ইস্টবেঙ্গল সমর্থক, হাতে পতাকা, মুখে স্লোগান। এলাকায় পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে বেশ কিছু। সমর্থকদের মিছিলে তখন মিডিয়ার ভিড়। চলছে ক্লাবের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্লোগান। প্রায় সেই ভিড়ে পৌঁছেই খুঁজে পেলাম বহু চেনা মুখ। ইস্টবেঙ্গল সমর্থক হওয়ার সুবাদে এই চেনা মুখেদের সঙ্গে কোনো এক আত্মিক টান। সকলে সম্মিলিতভাবে শুরু করলাম স্লোগান। মাঝে মাঝে লেসলি ক্লডিয়াস দিয়ে গাড়ি এলে ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে অন্য রাস্তায়। ক্লাব থেকে বেশ কিছুটা দূরে পুলিশের ব্যারিকেড। তারপর থেকে ক্লাবকর্তা ও তাঁদের কিছু পরিচিতের যাতায়াত।

এদিকে লেসলির রাস্তা ধরে ভিড় বাড়তে লাগল ক্রমেই। নানা ফ্যানস ক্লাবের পক্ষ থেকে প্রচুর সমর্থক জমা হতে লাগলেন। এরই মাঝে খবর এল ক্লাবের ভেতর থেকে নাকি নির্দেশ এসেছে কতিপয় নির্বাচিত সমর্থকের সঙ্গে কর্তারা কথা বলতে চান। স্বভাবতই রাজি নয় কেউ। ঐ উত্তেজিত জনতার সামনে ক্লাব কর্তারা আসবেন না। পুলিশের সটান জবাব। এর মাঝেই হিন্দোলদা, সুকান্তদা সকলে মিলে কাগজে লিখছিলাম সমর্থকদের স্পষ্ট দাবি, বয়ান।  লক্ষ করছিলাম বাইরের কিছু ছেলে ঢুকেছে ঐ ভিড়ের ভেতর। ইতিমধ্যে এল এক গাড়ি। আচমকা গুটিকয়েক অচেনা মানুষ সেই গাড়ি ঘিরে শুরু করলেন বিক্ষোভ। সিনিয়ার সমর্থকদের চেষ্টাতেও থামানো গেল না তাঁদের। ফলে শুরু হল গোলমাল। আচমকা ব্যারিকেড খুলে পুলিশ ঢুকে শুরু করল লাঠি চার্জ। আমরা ক'জন কোনোমতে লুকিয়ে পড়লাম একটু দূরে। খেয়াল করলাম এক মহিলা সমর্থক দৌড়তে গিয়ে পড়ে গেছেন মাটিতে। পুলিশের লাঠির সামনে তিনি অসহায়। মোহনবাগান তাঁবু পেরিয়ে বাবুঘাটের দিকে এসে খবর পেলাম গ্রেফতার হয়েছেন বহু সমর্থক, গুরুতর আহতও কতজন। 

পুলিশের ভিড় পুরো অঞ্চলে।

আরও পড়ুন
ইস্টবেঙ্গলের জার্সি গায়ে হ্যাটট্রিক কর্ণাটকের যুবকের, অকালপ্রয়াত কিংবদন্তি কার্লটন

‘এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা’- হেঁটে দেখতে শিখেছি যবে থেকে তারও আগে থেকেই ইস্টবেঙ্গল, জন্মকবচে লালহলুদ। কোটি কোটি জনতার। সেই সুরেশবাবুরা জোড়াবাগান ভাঙলেন, মোহনবাগান আধিপত্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল বাঙাল ঔদ্ধত্য। সে কালে কালে জুড়ে নিল রাজনীতি থেকে সমাজের গুঁড়ো গুঁড়ো আবেগ, জুড়ে গেল কত কত মানুষ। ধর্মতলায় ভবঘুরে বার্মিজ রিফিউজি ফ্রেড পাগস্লে এলেন, জ্যোতিষ গুহ একটা গমভাঙার যন্ত্রের লোভ দেখিয়ে এনেছিলেন এই ভারতের অন্যতম সেরা প্রতিভা দক্ষিণী ভেঙ্কটেশকে। চারের দশকের শেষ থেকে ঐতিহাসিক পঞ্চপাণ্ডব জমানা। সাতের গোড়া থেকে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা, সঙ্গে স্বাধীনতার পর রিফিউজি আবেগের সাথে স্তরে স্তরে মিলেমিশে যাওয়া বাঙাল আবেগ, জ্যোতিষ গুহ, অজয় শ্রীমানি থেকে পল্টু-জীবন হয়ে নব্বই-এর দশকে একের পর এক সাফল্যের পিছনে থেকে যাওয়া দক্ষ প্রশাসনিক মগজ— ইস্টবেঙ্গল তাঁর অগণিত ভক্তকে খালি হাতে ফেরায়নি কোনোদিন, একুশ শতকের গোড়ায় ক্লাবে এল ঐতিহাসিক আশিয়ান। এরপর মর্গ্যান জমানাতেও সাফল্যের মুখ দেখল ক্লাব। চলে গেলেন স্বপন বল। ক্লাবে শুরু অরাজকতার। কোচ বদল থেকে কর্পোরেট হাউসের সঙ্গে বিরোধ, একের পর এক ব্যর্থতা— অথচ কেউ বুক পেতে দায় নিলেন না। বাঙাল অভিমানে সে এক জোর ধাক্কা। ফুঁসলে ওঠা ইস্টবেঙ্গল জনতার ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। ক্লাব কর্তাদের মৌরসীপাট্টার বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতিবাদ। মানুষ থেকেই এসেছে মানুষ। বিক্ষোভে-বিপ্লবে সে খুঁজেছে মুক্তির পথ। ইস্টবেঙ্গল এবছর টার্মশিট সই না করলে খেলতে পারবে না কোনো টুর্নামেন্ট। শতবর্ষের ইতিহাসে যা কখনো হয়নি। কর্তাদের চুক্তি নিয়ে যে অস্বচ্ছ মন্তব্য তা না-পসন্দ অগণিত সমর্থকের। ক্লাব বিক্রির যে তত্ত্ব তাঁরা আনছেন তাতেও থেকে যাচ্ছে ধোঁয়াশা। 

আরও পড়ুন
আইএসএল-এর একাদশ দল ইস্টবেঙ্গল, রবিবার সকালে মিলল চূড়ান্ত শিলমোহর

শিলিগুড়ি, বর্ধমান থেকে মানুষ আসলেন। একজন সমর্থকের চাওয়াটুকুই তো সত্যি, সামান্য সে চাওয়ায় মিশে থাকে অনেক অতৃপ্তির ধুলো। ইস্টবেঙ্গল ফুটবল খেলবে, দেশের সর্বোচ্চ লিগে খেলবে, চ্যাম্পিয়নের মতো সে খেলবে মাঠজুড়ে— অথচ বছরের পর বছর ক্লাব কর্তারা ব্যর্থ হচ্ছেন দল গড়তে, ট্রফি নেই কতকাল। বাঁধ ভাঙছে ধৈর্যের। এ ব্যর্থতার দায় কার? ক্লাবে স্বচ্ছ সদস্যপদ নীতি নেই। সদস্য হতে চাইলেও মেলে না  সুযোগ। 

আরও পড়ুন
নাকে অক্সিজেনের নল নিয়েই মাঠে নামলেন আপ্পারাও, মোহনবাগানকে হারিয়ে শিল্ড জিতল ইস্টবেঙ্গল

প্রাক্তন খেলোয়াড় থেকে মিডিয়া— সকলেই ধন্দে। এই সময় শক্ত করে ধরতে হবে হাল। সমর্থকদের দাবি অলীক নয়, শতাব্দী প্রাচীন প্রতিষ্ঠান তো শুধু ফুটবল ক্লাব নয়, কোটি কোটি লালহলুদ প্রাণের মুক্তির ঠিকানা। পায়ে বল পেলেই তার মুক্তি। স্থানু সময়ের ভেতর তাকে উঠে দাঁড়িয়ে শুরু করতে হবে নতুন দৌড়। সমর্থকদের ভিড় সরে এল বাবুঘাটের দিকে। ঘরে ফিরছে কত ক্লান্ত পা, কিন্তু আবার ফিরবে ওরা। বারেবারে ফিরবে। বাড়ি-গাড়ি-সম্পত্তির বদল হলেও বদলায় না প্রিয় ক্লাব, প্রিয় রঙ- বলেছিলেন এরিক ক্যান্টোনা। ইস্টবেঙ্গল এখানে বিপ্লবের নিশান। ঘরে ফেরা মানুষের ময়দানে ফিরে ফিরে আসার মন্ত্র। বিকেলের পড়ন্ত রোদে মনখারাপি সন্ধ্যা নেমে আসে লেসলি ক্লডিয়াসে, ঘোড়সওয়ার পুলিশের মার, তবু তখনও রাস্তায় পড়ে আছে কিছু মানুষ। মাটি আঁকড়ে থেকে লড়ে যাবার কবচ তো এই ক্লাবই দিয়েছে আমাদের। যে ক্লাবের জন্মই হল বিদ্রোহ থেকে, প্রতিবাদ থেকে তাকে দমাবে কোন শক্তি? 

পুলিশের লাঠি, ক্ষমতার দম্ভ ঠেলে নড়ে নড়ে এগোচ্ছে সাদামাটা মানুষের মাথা, আমার ক্লান্ত পা ফিরে যাচ্ছে পুরোনো স্কুল কাট, কলেজ ডুব মেরে বার বার ছুটে যাওয়া কাঠের গ্যালারির দিকে। ইস্টবেঙ্গল— একটাই নাম। তাড়া করে রোজ। সেখানে লেপে আছে কৈশোর-যৌবন জুড়ে কত পাওয়া-না পাওয়ার কিসসা। অলক্ষে হলদে আকাশের ভেতর লাল টিপের মতো হয়ে আছে কতগুলো মানুষের জানকবুল লড়াই-এর দাগ, সুদিন ফিরবে, ফিরে আসার চেয়ে বড়ো সত্যি যে আর নেই...

ছবি ঋণ - ফেসবুক ও টুইটার

Powered by Froala Editor