দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রেশ তখনও কাটেনি। ভারতের ঔপনিবেশিক শাসনে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয় চল্লিশের দশকে, তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে কলকাতা, মাদ্রাজ, দিল্লি আর বোম্বাই-এর মতো বড় শহরগুলিতেও। এদিকে কলকাতায় তখন কলোনি গঠনের তৎপরতা ও উদবাস্তু সমস্যা বাড়ছে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে এই শহরে বদলাচ্ছে না উন্মাদনার ভাষা, বদলাচ্ছে না আবেগের বহিঃপ্রকাশের স্বতঃস্ফূর্ততা। কলকাতার ময়দান এলাকায় বেশ জমে উঠেছে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব তাঁবু। মোহনবাগানের বনেদিয়ানার পাশে সবুজ পাইন গাছের মতো কুয়াশা মেখে মাথা চাড়া দিচ্ছে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। সিকে নাইডুর নেতৃত্বে টেস্ট ক্রিকেটে যোগ্যতা অর্জনের পর যে সাময়িক উন্মাদনা দেখা গিয়েছিল ময়দান চত্বরে, তা একটু যেন ফিকে। বরং এসময়ে বাংলার ফুটবলে ঘটল এক বিস্ময়কর ঘটনা। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে এলেন পাঁচজন দিকপাল, একসঙ্গে যাঁরা হয়ে উঠলেন লাল-হলুদের পঞ্চপাণ্ডব। পরে ভারতীয় ফুটবলের ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সামার অলিম্পিকেও তাঁরা হয়ে উঠেছিলেন ভারতীয় ফুটবলের মুখ।
আহমেদ-সালে-ধনরাজ-আপ্পারাও এবং ভেঙ্কটেশ – পঞ্চপাণ্ডবের পাঁচ অবতারের পায়ের ছোঁয়া একসঙ্গে ময়দান দেখল ১৯৫০ সালে। সে সময়ে বিশ্ব ফুটবলে ব্রাজিল এবং উরুগুয়ের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। ২-৩-৫ ফর্মেশনে খেলা হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। কলকাতা ময়দানেও এর ছায়া পড়েছে ব্যাপকভাবে। মহামেডানে একসময় রহিম-রহমতের আমলে ২-৩-৫-এ খেলা হলেও, প্রথমবার কলকাতা এই ফর্মেশনের সফলতম প্রয়োগ দেখল পঞ্চপাণ্ডব জমানায়। ভেঙ্কটেশ খেললেন একেবারে রাইট উইং। ভারতীয় ফুটবলে প্রথম উইং থেকে কাট করে ভেতরে ঢোকার কৌশল মাঠে করে দেখালেন এই দক্ষিণ ভারতীয় কিংবদন্তি, একেবারে বাঁ দিকে খেললেন সালে, পঞ্চাশের দশকে যে সালের গতি ছিল চমকে দেবার মতন, সালে ও ভেঙ্কটেশের মাঝে মূল স্ট্রাইকারের পিছনে খেলতেন আপ্পারাও এবং আহমেদ খান।
পঞ্চপাণ্ডবের অর্জুন ছিলেন আহমেদ। বেঙ্গালুরুর মুসলিম ক্লাবে খেলা আহমেদ ভারতের প্রথম প্লে-মেকার হিসেবে আজও অমর হয়ে রয়েছেন। ব্যাঙ্গালোরে খেলাকালীন সাবেক ইস্টকর্তার নজরে আসেন তিনি। তাঁর সঙ্গেই কলকাতায় পা পড়ে ভারতীয় ফুটবলের স্বর্ণযুগের সুপারস্টারের। শৈলেন-চুণী থেকে পঞ্চাশ ষাটের ফুটবলাররা একবাক্যে মেনে নিয়েছিলেন আহমেদের ফুটবলপ্রতিভার কথা। আপ্পারাও এর সঙ্গে জুটি বেঁধে স্ট্রাইকারকে বল সাজিয়ে দিতে ওস্তাদ ছিলেন আহমেদ। আর পঞ্চপাণ্ডবের শেষ পাণ্ডব ছিলেন ধনরাজ। ধনরাজের গোল করার দক্ষতা ছিল দেখার মতো। শোনা যায়, সে সময়ে বিখ্যাত এক ব্রিটিশ ফুটবল ক্লাবকর্তার নজরেও পড়ে গিয়েছিলেন ভেঙ্কটেশ, কিন্তু তিনি ভারত ছেড়ে যেতে রাজি হননি।
এই পঞ্চপাণ্ডব ইস্টবেঙ্গল তথা কলকাতা ময়দানের চেনা ছক ভেঙে নতুন ইতিহাস লিখে দিলেন ১৯৪৯-৫৩ - এই তিন বছরে। তিন বছরে পঞ্চপাণ্ডবের দাপটে ইস্টবেঙ্গল গোল করল ২৬০টি। যা আজও বিস্ময়। ধনরাজের গোল সংখ্যা ১১৪ ও আহমেদের ৩৫। কিন্তু আহমেদের পাসিং দক্ষতাই যে ১১৪ গোলে বড় ভূমিকা নিয়েছিল, তা ১৯৫৩-তে প্রকাশ্যে মেনেও নেন ধনরাজ।
শুধু তো গোল নয়, ইস্টবেঙ্গল ক্লাব স্থাপনের পর প্রথম এক জমানা ধরে রাজত্বের নজির গড়ে উঠল এই সময়ে। ১৯৪৯ সালে পঞ্চপাণ্ডবের হাত ধরে লেসলি ক্লডিয়াসে ঢুকল লিগ-শিল্ড-রোভার্স ত্রিমুকুট৷ ১৯৫১ সালে প্রথম ভারতীয় ক্লাব হিসেবে ডুরান্ড জয়, ওই বছরই আইএফএ শিল্ড জয় যেন চমকে দিল সারা দেশকে। কিন্তু পঞ্চপাণ্ডবের সব থেকে বড় সাফল্য হয়তো এসেছিল ১৯৫৩ সালে, যখন রোমানিয়ায় ফুটবল ইয়ুথ কংগ্রেসে আমন্ত্রিত দল হিসেবে রোমানিয়া গেল ইস্টবেঙ্গল। যদিও এই টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই সরে দাঁড়ান ধনরাজ। ইউরোপিয়ান আবহাওয়া মানিয়ে প্রথম ম্যাচে অস্ট্রিয়াকে ২-০ গোলে হারিয়ে অভিযান শুরু করে তারা। পরের ম্যাচে লেবাননকে ৬-১ হারায় তারা কিন্তু জার্মানির বিপক্ষে ৫-২ হেরে টুর্নামেন্টে চতুর্থ হয় ইস্টবেঙ্গল। ১৯৫৩-তে আরেকটি বড় সাফল্য আসে মস্কোতে, টর্পেডো মস্কোর মতো দলের বিপক্ষে তুষারপাতকে উপেক্ষা করেও ইস্টবেঙ্গল ৩-৩ ড্র রাখে ম্যাচ...
পঞ্চপাণ্ডবের স্মৃতিচারণে একবার দলের ডিফেন্ডার ব্যোমকেশ বোস বলেছিলেন, সামনে থেকে যাঁরা দেখেছেন তাঁরাই জানেন পঞ্চপাণ্ডবের ফুটবলের প্রকৃত স্বাদ। এই পঞ্চপাণ্ডব বড় ভূমিকাও নিয়েছিলেন ভারতের জাতীয় দলেও। ১৯৪৮ ও ৫২ অলিম্পিকের সাফল্যের নেপথ্যেও কিন্তু এঁদের অবদান অনস্বীকার্য।
আরও পড়ুন
ইস্টবেঙ্গল লিগ জেতায়, দুঃখে ‘দেশান্তরী’ হয়ে গিয়েছিলেন মোহনবাগানী লালাকাকু
তারপর সময়ের নদী বয়ে গেছে কালে কালে, ফুটবল তার রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ নিয়ে বয়ে চলেছে আজও একইভাবে, তার প্রতিবাঁকে সম্বৃদ্ধ হচ্ছে ইতিহাসের হলুদ পাতা। ভারত স্বাধীনতার পর পেরিয়ে গেছে ৭২ বছর, পঞ্চাশের মন্বন্তর থেকে ছিয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, একাত্তরের উত্তাল দিন পেরিয়ে কলকাতা আজও কল্লোলিনী। সেদিনের মতো আজও শত ঝড়ের পরেও এই শহরের আবেগের বহিঃপ্রকাশ বদলায়নি। তাই হয়ত লালহলুদের সোনালি দিনের ইতিহাসে আজও প্রাসঙ্গিক পঞ্চপাণ্ডব। কিংবদন্তি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথায় তাই আজও উঠে আসে পঞ্চপাণ্ডবের ফুটবলের কথা। লাল-হলুদ গ্যালারি বদলে গেছে নতুন প্রজন্মের আদলে, শুধু বেঁচে আছে নিশ্চুপ রেকর্ডবুক আর একটুকরো ইতিহাস - গর্বের ইতিহাস, ভালোবাসার ইতিহাস...
ছবি ঋণ - https://eastbengalclub.co.in/
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
মহামেডানের হয়ে ময়দান কাঁপালেন ‘ফুটবলার’ সৌরভ, নাস্তানাবুদ ইস্টবেঙ্গলও