কৃষ্ণ কি সত্যিই মিথ? নাকি সত্য? কী বলছে গবেষণা?

আজ জন্মাষ্টমী। মহাভারতখ্যাত কৃষ্ণের জন্মতিথি। তিনি এমন একটি চরিত্র যার প্রতি ভক্তিরসে জারিত হয়ে বিরাট বড় সংখ্যক মানুষ আন্দোলিত হন। যাকে নিয়ে আজও লেখা হয় অজস্র গান, অজস্র সাহিত্য। যার মুখনিঃসৃত কথা অথবা বাণী 'গীতা' নামে বহুল প্রচলিত হয়ে হিন্দু ধর্মের ধারক হয়ে ওঠে। শুধু কি জ্ঞান? ভালোবাসারও মহানায়ক তিনি।

বেশ কিছু কাঠের কাঠামোর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বয়স-নিরীক্ষণ করে দেখা যায়, প্রায় ৭৫০০ সাল পুরনো সেই সব কাঠামো।

কিন্তু কে এই কৃষ্ণ? তিনি কি শুধুই কাল্পনিক চরিত্র? নাকি বাস্তবেও তাঁর কোনো অস্তিত্ব ছিল? আপামর মানুষ এই বিষয়ে ভাবিত নন। তাঁরা 'ঈশ্বর' নামক ধারণার আড়ালে ভক্তি-প্রদর্শনেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। কিন্তু কিছু মানুষ তো ব্যতিক্রম থাকেনই। বর্তমানে গুজরাতের গালফ অফ খাম্বাত অঞ্চলে সমুদ্রের নিচে বেশ কয়েকবার খননকার্য চালায় ভারত সরকারের মেরিন আর্কিওলজি বিভাগ – ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ওশান টেকনোলজি।

আরও পড়ুন
কেন নারীলোলুপ পুরুষ নন কৃষ্ণ? জানিয়েছিলেন ইসমত চুগতাই

এই খননকার্য বেশ কিছু কারণে বিতর্কিত। শোনা যায়, সেখানে সমুদ্রের তলায় পাশাপাশি দুটি শহরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। সেই শহরদুটির পাশে পুরনো একটি নদীর রেখার সন্ধানও পাওয়া যায়। সেখানে বেশ কিছু কাঠের কাঠামোর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বয়স-নিরীক্ষণ করে দেখা যায়, প্রায় ৭৫০০ সাল পুরনো সেই সব কাঠামো। জানা যায়, সেটি ছিল একটি বন্দর-শহর। পরিকাঠামোয় যা ছিল যথেষ্ট উন্নত।  মেরিন আর্কিওলজিস্ট ডক্টর এস আর রাও একটি নিবন্ধে দাবি করেন, সমুদ্রের নিচে পাওয়া এই শহরই মহাভারতখ্যাত কৃষ্ণের দ্বারকা-নগরী। সেখানে অসংখ্য মন্দির এবং জাহাজের সন্ধান পাওয়া গেছে।

https://www.youtube.com/watch?v=NVIsjx5X3QM

মহাভারতে কী লেখা আছে দ্বারকার ধ্বংস নিয়ে? লেখা আছে, কৃষ্ণের মৃত্যুর ৩৬ বছর আগে নাকি খাম্বাত উপসাগরে নিমজ্জিত হয়েছিল দ্বারকা। বাস্তবে সেই অঞ্চলেই পাওয়া গেছে ধ্বংসাবশেষ। খাম্বাত উপসাগরের কাছে বেট-দ্বারকা অঞ্চলে এখন ভয়ঙ্কর সামুদ্রিক প্রাণীদের বসবাস হওয়ার কারণে ডুবুরিদের অনুসন্ধান চালাতে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তবু সেই সব বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে সেখান থেকে পাথরের তৈরি বিভিন্ন স্থাপত্য, লোহার নোঙর, মুদ্রা, মালা ইত্যাদি উদ্ধার করে আনা গেছে। সমুদ্রের ধার ধরে প্রায় নব্বই কিলোমিটার নিচে মন্দিরের চূড়া, প্রাচীন দুর্গের সন্ধান পাওয়া গেছে, যার বয়স আরও পুরনো। অনুমান করা হয়, আরব-ভারত ব্যবসায়িক যোগাযোগও ছিল সেই সময়ে। বলা ভালো, প্রাচীন ইতিহাসের সম্ভার লুকিয়ে আছে গুজরাতের এই অঞ্চলে, সমুদ্রের তলায়।

কৃষ্ণের রহস্য উদ্ধার হয়ে গেলে কি তাঁর দেবত্বে দাঁড়ি পড়ে যাবে? সবাই জেনে যাবে, তিনি আসলে 'দেবতা' ছিলেন না, ছিলেন একজন বুদ্ধিমান এবং জ্ঞানী মানুষ?

প্রত্নতাত্ত্বিক এই অভিযান আরও কিছুদিন চালানো হলে আরও অনেক সত্য আমাদের কাছে উঠে আসতে পারত। হল না। এই নিয়ে হইচই শুরু হয়েও থেমে গেল। সরকারের পক্ষ থেকে খননকার্য বন্ধ করে দেওয়া হল। মনে প্রশ্ন জাগে, কেন? তাহলে কি কৃষ্ণের রহস্য উদ্ধার হয়ে গেলে তাঁর দেবত্বে দাঁড়ি পড়ে যাবে? সবাই জেনে যাবে, তিনি আসলে 'দেবতা' ছিলেন না, ছিলেন একজন বুদ্ধিমান এবং জ্ঞানী মানুষ? নাকি সত্যি-সত্যি কৃষ্ণের সঙ্গে জুড়ে ছিল কোনো অলৌকিক ক্ষমতা?

কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যে কে বলতে পারে! তা লুকিয়ে রয়েছে গুজরাতের সমুদ্রের বহু নীচে। কিন্তু সেই সত্য জানতে যে পরিমাণ পরিশ্রম এবং নিষ্ঠা দরকার, দুঃখজনক ভাবে ভারতবাসীর মধ্যে তার খামতি আছে। আমরা এত খাটুনি করতে রাজি নই। আমরা একদল, কৃষ্ণকে 'দেবতা' ভেবে ফুল, বেলপাতা দিয়ে তাঁকে পুজো করে ভক্তিতে তাঁর প্রতি ধার্মিক ভাবে মগ্ন হয়ে আছি। অন্যদিকে, আরেকদল, যারা নিজেদের যুক্তিবাদী এবং ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করি, তাঁরাও এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকি, ভাবি, যদি সত্যি সত্যি প্রমাণিত হয়ে যায় কৃষ্ণের অস্তিত্ব? তার চেয়ে চুপ করে থাকা ভালো। এই দুইয়ের মাঝখানে ইতিহাস ডুবে আছে জলের তলায়, দ্বারকায়।   

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

ছবি ঋণ - ইউটিউব