পুরুলিয়ার গ্রামে বেহিসেবি কর্মজীবনের দু’টো বছর পেরিয়ে যাওয়ায়, উৎসবের ছুটিছাটায় ঘরে না ফিরতে পারলেও অসুবিধা হয় না আর। অন্য একটা ঘর-পরিবার বসে গিয়েছে সেখানেও। সেই সঙ্গে সঙ্গে জাঁকিয়ে ধরেছে মাথা ব্যাথা, সাইনাস ইত্যাদি হাবিজাবি। অসহ্য কাজের চাপে হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করা গেল জুলফির পাশে একটা সাদা রেখাও।
অক্টোবর মাস। কলকাতা বসে মানভূমের প্রকৃতির আঁচ করা খুব মুশকিল। অগত্যা ভোরের বাসে পুরুলিয়া স্টেশন থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরের গ্রামে পৌঁছতে পৌঁছতে, ঠান্ডা হাওয়াটা বশে নিয়ে নিয়েছিল মাথা-কপাল সবটাই। অগত্যা বিকেল পেরোতে না পেরোতেই, বেশ কিছুদিন পর আবার সেই জঘন্য মাথা ব্যাথাটা কমিউনিটি রেডিয়ো স্টেশন থেকে বের করে দিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরের পথ ধরিয়ে দিল। ফেরার পথে মাথা ব্যথার অ্যান্টিডোট নিতে দাঁড়ানো গেল চা’য়ের দোকানে। সেখানেই পাকড়াও করল প্রায় আমারই সমবয়সী অথবা দু-এক বছরের বড় ইমন, যার ভাল নাম ইমন কল্যান এবং যে ওই প্রত্যন্ত গ্রামের অতি সাধারণ একটা রেডিয়ো স্টুডিয়োতে বসে অদ্ভুত অদ্ভুত প্রোডাকশন করে চমকে দেয়। স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে প্রায় ‘আগুন গরম’ চা গলায় ঢেলেও যখন মাথা ব্যাথা কমেনি, বুঝতে পারছি আজকে ভোগান্তি চরমে, তখনই ইমন বাইক নিয়ে একদম গা ঘেঁষে : ‘ঘর চললে?’ ১০-১২ মিনিটের হাঁটা পথকেই মনে হচ্ছিল ১০-১২ মাইল বলে! ফেরেস্তা ইমনের বাইকে উঠে পড়া গেল।
দু’পাশে ছোট ছোট চাষ জমি, নিচু পুকুর, ছোট ছোট ঘর-বাড়ি। মাটির দেওয়াল। খোলা মাঠের মধ্যে বাৎসরিক যাত্রাপালার জন্য বাঁধানো স্টেজ। হাওয়ার ঝাপটা এড়াতে অনুরোধ, ‘একটু আস্তে চালিও!’ অনুরোধের আর্জি মান্যতা পাওয়ায় আস্তেই উড়ছে দু’চাকা! বাইকের পিছনে খেয়াল করে ডাক দিচ্ছে কেউ কেউ, ‘আজ আসা হইল্য?’ মাথা নেড়ে যাচ্ছি, তখনই ইমন বলল, ‘এবার একটু ইস্পিড নিই, নাকি?’ ঠিক তখনই হঠাৎ একটা পুকুরের পাড়ে নেমে যাওয়া ঢালের ঘাস জমিতে ওই ছবির ওদের সঙ্গে দেখা। এক ঝাঁক কচিকাঁচা। বেশ কোলাহল। কিন্তু উন্নয়ন বা প্রযুক্তির গতিবেগ ছোটদের আনন্দের উৎসগুলো কবেই বা ধরতে পেরেছে! অগত্যা পুনরায় অনুরোধ করে বাইক থামানো গেল। বাইকের থেকে নেমে আবার কিছুটা হেঁটে গেলাম পিছনের দিকে।
কচিকাচাদের আয়োজনের উপাদানে কমতি হলেও, উৎসাহে ভাঁটা নেই যদিও। খানিক গল্প করা গেল।
— এটা কী বঠে রে?
— রাবণ!
— তা রাবণের বাকি মাথাগুলো কই?
— ছাড়াইন গেছে।
— হ্যাঁ?
— বাকি মাথা গুলহ্ ঘুচাইন গ্যাছে গ!
— ওহ হো! তা, এটা কী হবে এরপর?
— আগুন দিব! আর পটকা জ্বালাব! ছ'টা বাইজলে চলি আসবে।
অনুভব করি, জীবনের এইসব ছোট ছোট আবিষ্কারের মধ্যে অনাবিল আনন্দ আছে। প্রচণ্ড বেঁচে থাকা আছে। আর চার পাশের এই ভীষণ ধর্ম নিয়ে রাজনীতি বা অসহিষ্ণুতার মধ্যেও শিখিয়ে দেওয়া আছে যে, জীবনে আসলে সত্যিই সারল্যের থেকে বেশি আর কিছুরই প্রয়োজন নেই। যেমন রাবণেরও আর দশটা মাথার প্রয়োজন হচ্ছে না; এই তিনটে মাথাতেই কাজ চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছে বেশ।
এই টুকরো টুকরো মুহূর্তের হাত ধরে ছেলেবেলায় ফিরে যেতে ইচ্ছা করে খুব। কয়েক মুহূর্ত বসে থাকতে ইচ্ছা করে নিজের শৈশবের পাশে। প্রিয় গানের কথা মনে আসে এর মধ্যেই, ‘মন সে রাবণ যো নিকালে, রাম উসকে মন মে হ্যায়’।
উঠে পড়তে পড়তে বোধ করি, মাথার হাতুড়ি পেটা শ্রমিকগুলো জলপানের বিরতিতে গিয়েছে বোধহয়...
রাস্তায় দেখা হয় কাজের বাইরে ওখানে আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী ক্লাস ইলেভেনের সুব্রতর সঙ্গে, যার ডাক নাম ‘ভ্যাবলা’! ফুটবল নাচিয়ে নাচিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ফিরতে ফিরতে চেঁচিয়ে বলে, ‘ভাল দিনে আসছ! এ তো ছোট রাবণ! রাতে যাব, বড় রাবণ পোড়া দেখত্যে...’
ফুটনোট :
মানভূম অঞ্চলের বেশ কিছু জায়গায় কালীপুজোর রাতে রাবণ পোড়ানোর চল আছে। সাধারণত মানভূমের বুক চিরে এগিয়ে চলা পাথুরে নদীগুলোর উপরেই রাবণের মূর্তি দাঁড় করিয়ে আগুন ছোঁড়া হয় তার মধ্যে। রাবণের শরীরের মধ্যে ভরা থাকে নানা রকম আতসবাজি। রাবণ পোড়া কখন যেন হয়ে ওঠে আতসবাজি প্রদর্শনী। নদীর পাড়ের বালিতে নানা রকম জিনিসের পসরা। ছোটখাট মেলা। কাতারে কাতারে লোক। দেশি নেশার গন্ধ। টলোমলো পা। সেই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে অন্যরকম ভাবে চিনতে থাকি দেশ। দেশের মানুষগুলোকে। উৎসবকে চিনতে শিখি। রাতের আলো-অন্ধকারে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে আবার সেই পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে ফেরা। তবু ক্লান্তি লাগে না। শুধু মনে হয়, এই সব হেঁটে চলা তো চিরন্তন হতে পারত আমার। এই সব হেঁটে চলা তো চিরন্তন হতে পারত, আমাদেরও...