সিনেমায় দুর্গাপুজো; বাঙালির ‘শ্রেষ্ঠ’ উৎসবকে যেভাবে দেখেছেন সত্যজিৎ রায়

সত্যজিৎ রায়। এ-বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ। বাঙালি জীবনের বহু আনাচে-কানাচে আলো ফেলেছেন এই স্বনামধন্য পরিচালক। উঠে এসেছে দুর্গাপুজোও। তাঁর পরিচালনায় কখনও প্রসঙ্গ হিসেবে, কখনও আবার গল্পের মূল সূত্র হিসেবেই হাজির বাঙালির এই উৎসব। আজ রইল, সত্যজিত রায়ের ছবিতে দুর্গাপুজোর গপ্পো। 

পথের পাঁচালী (১৯৫৫):
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে, 'পথের পাঁচালী' হল সত্যজিতের পরিচালিত প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র। এই ছবিতে নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে রায়বাড়ির দুর্গোৎসবের কয়েকটি ঝলক দেখিয়েছেন পরিচালক। দুর্গাপুজোয় কেমন করে কয়েক দিনের জন্য ধনী দরিদ্রের প্রভেদ ঘুচে যায়, কেমন করে খুশিতে মেতে ওঠে কচিকাঁচার দল, তারই কয়েকটি আনন্দময় মুহূর্ত ধরা পড়েছে এই ছবিতে।

দেবী (১৯৬০):
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরামর্শ অনুসারে লেখা প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের 'দেবী' গল্প অনুসরণে পরিচালক এই ছবিটি বানিয়েছিলেন। একটি স্বপ্নদৃশ্যের উপর ভিত্তি করে শ্বশুর কালীকিঙ্কর নিজের কনিষ্ঠা পুত্রবধূ দয়াময়ীকে (অভিনয়ে শর্মিলা ঠাকুর) সাক্ষাত দেবীর অবতার হিসাবে পূজা করতে আরম্ভ করলেন, এবং তাঁর এই অন্ধবিশ্বাস-জনিত আচরণের ফল তাঁর পরিবার ছারখার হয়ে গেল - এই হচ্ছে এ-চলচ্চিত্রের মূল বিষয়। এই ছবিটি বানানোর জন্য রায়মশায়কে নানারকম বিতর্কের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।

দেবী চলচ্চিত্রের শুরুতেই বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি সাবেকি ধাঁচের মৃন্ময়ী দুর্গাপ্রতিমার আস্তে আস্তে গড়ে ওঠার দৃশ্য দেখানো হয়েছে, এবং সেই সঙ্গেই চলেছে একের পর এক টাইটেল কার্ড। ধুমধাম সহ দুর্গোৎসবের দৃশ্যও মূল কাহিনির ভূমিকা হিসাবে এই ছবিতে আছে। স্বয়ং পরিচালক এই ছবির জন্য রামপ্রসাদী সুরে "এবার তোরে চিনেছি মা" গানটি বেঁধেছিলেন।

আরও পড়ুন
দুর্গার পাশেই বঙ্গবন্ধুর ছবি, ১৯৭১-এর পুজো ও এক মুসলমান ‘দেবতা’র গল্প

নায়ক (১৯৬৬):
এই ছবিতে, বিখ্যাত ম্যাটিনি আইডল অরিন্দম মুখার্জির (অভিনয়ে উত্তমকুমার) স্মৃতিচারণে উঠে এসেছে তাঁর পাড়ার দুর্গাপুজোর কথা, মহাষ্টমীর দিন নাটক করার কথা। "শঙ্করদা বলত যে ওই চালচিত্তির, ডাকের সাজ, ড্যাবড্যাবে চোখ না হলে ঠিক ভক্তি আসে না।"- জানাচ্ছেন অরিন্দম। তাই, তাঁদের পাড়ায় মায়ের সাজ হত এক্কেবারে সাবেকি ধরনের। আর সেই পুজোয় বিজয়াদশমীর দিনই ঠাকুর বিসর্জনের সময়ে আচমকা মাটিতে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারান শঙ্করদা, অরিন্দমের নাট্যগুরু। সেই জ্ঞান আর ফেরেনি, থ্রম্বোসিসে আক্রান্ত শঙ্করদার সেদিনই দেহান্ত হয়। 

জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৯):
এ ছবির পুরোটাই গড়ে উঠেছে দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে। ছবির শুরুতে দেখা যায়, কাশীর ঘোষালবাড়ির ঠাকুরদালানে প্রতিমা গড়া হচ্ছে, আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে বাড়ির ছোট্ট ছেলে রুক্মিণীকুমার ওরফে রুকুর সঙ্গে গল্প করছেন বৃদ্ধ শশী পটুয়া। শশীবাবুর গল্প থেকেই জানা যায়, বাঙালির দুর্গাপুজোর পৌরাণিক ইতিবৃত্ত। শশী পটুয়া বলেন,

আরও পড়ুন
প্রয়াত সত্যজিৎ রায়ের সহকারী পরিচালক রমেশ সেন, দীর্ঘ ৭ দশকের অধ্যায়ে ইতি

"তখন দেবতারা বললেন- সর্বনাশ, এই অসুরের সঙ্গে তো পারা যাচ্ছে না! ব্রহ্মা একে এমন বর দিয়েছেন যে কোনো পুরুষ দেবতা একে বধ করতে পারবে না। তখন বিষ্ণু বললেন যে- এসো, আমাদের শরীরে যে তেজ আছে, সেই তেজ এক সঙ্গে মিশিয়ে আমরা এমন এক দেবী সৃষ্টি করি, যার হাতে মহিষাসুরকে মরতেই হবে। সেই চারজনের তেজ- ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব আর ইন্দ্র- আর সেই সঙ্গে আরো সব দেবতাদের তেজ একসঙ্গে মিলে সৃষ্টি হলেন দেবী দুর্গা। এই দুর্গার দশ হাতে দশরকম অস্ত্র। সেই অস্ত্র দিয়ে তার বাহনে চড়ে..." (এইখানে রুকুর প্রশ্নে শশীবাবুকে দেবদেবীদের বাহন নিয়ে কয়েকটা কথা বলতে হয়, তারপর আবার তিনি মূল গল্পে ফিরে যান)

"...মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করলেন দেবী। মহিষাসুর বললেন, দেবী, তোমার হাতে মরতে হবে জানি; তুমি এমন কর যেন তোমার পুজোর সঙ্গে সঙ্গে লোকে আমারও পুজো করে। দেবী বললেন, তথাস্তু। (আবার একটু থেমে, রুকুকে বলে দিতে হল ‘তথাস্তু’ শব্দের মানে ‘তাই হোক’।) 

আরও পড়ুন
সত্যজিতের চিত্রনাট্যের কর্মশালা

... সেই থেকে মহিষাসুর রয়ে গেলেন দেবীর পায়ের তলায়। আর দেবীর সঙ্গে সঙ্গে তাঁরও পুজো হতে লাগল!" 

খুব সহজ, সরল, প্রাঞ্জল ভাষায় পুরাণের দুর্গা-কাহিনি উপস্থাপন করলেন শশীবাবু।

গল্পের সঙ্গে এই দুর্গাপ্রতিমার যোগাযোগ অতি ঘনিষ্ঠ। কুখ্যাত স্মাগলার মগনলাল মেঘরাজ ঘোষালবাড়ির প্রাচীন গণেশ মূর্তি হাতিয়ে নেবার ধান্দা করছে শুনে, রুকু আর তার দাদু অম্বিকা ঘোষাল (দুজনেই ডিটেকটিভ গল্পের পোকা) চিউয়িং গাম দিয়ে সেই মূর্তি লুকিয়ে রাখেন সিংহের মুখে। এই আইডিয়াটি তাঁরা পেয়েছিলেন জটায়ু ওরফে লালমোহন গাঙ্গুলির রহস্য-রোমাঞ্চ উপন্যাস 'করাল কুম্ভীর' পড়ে। এই গণেশের কারণেই মগনলালের গুণ্ডাদের হাতে খুন হন শশীবাবু। বিজয়াদশমীর দিন ফেলুদার কূটবুদ্ধিতে মগনলাল ধরা পড়েন, ধরা পড়েন তাঁর সাজানো ভণ্ড সাধু মছলিবাবা। গণেশ উদ্ধার হয়। অত:পর প্রকাশ হয়, এই গণেশ আসলে নকল, আসল গণেশ চোর-ডাকাতের ভয়ে ব্যাঙ্কের লকারে রেখেছেন অম্বিকা। ফেলুদার গোয়েন্দাগিরির সাফল্যে প্রসন্ন ঘোষালমশায় তাকে এই নকল গণেশমূর্তিটি পারিশ্রমিক হিসাবে উপহার দেন। 

সব মিলিয়ে, বাঙালির দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে সত্যজিত রায় যে গোয়েন্দা কাহিনির প্লটটি ফেঁদেছিলেন, তা এক কথায় অনবদ্য! একেবারে লা-জবাব!

Powered by Froala Editor