যত দিন গেছে, পুজোর চালচিত্র বদলেছে। একচালা থেকে পাঁচচালায় এসেছেন প্রতিমা, সাবেক ঘেরাটোপ থেকে সমাজের বাকি অংশেও ছড়িয়ে পড়েছে। সেইসঙ্গে বদলেছে আর্থিক চিত্রটাও। একটা সময় বনেদি বাড়ির নিজস্ব ঘরানাগুলোই ছিল আকর্ষণের মূল কেন্দ্র। সেই সাবেক রীতি একদিন চলে এল পাড়ায়। বারোয়ারি পুজোর হাত ধরে শুরু হল চাঁদা তোলা। সে এক আলাদা আনন্দ। তার অন্যরকম পরম্পরা। সেই থেকে পুজো আর চাঁদা জড়িয়ে গেছে অঙ্গাঙ্গীভাবে। আর আজকের আধুনিক সময়ে যুক্ত হয়েছে স্পনসর, কর্পোরেট সংস্থা। জাঁকজমকও বেড়েছে। কিন্তু লটারির টাকায় দুর্গাপুজো— এমন নজির কি কেউ দেখেছে? চেষ্টা করেও হয়ত কারোরই মনে পড়বে না।
তাহলে লটারির প্রসঙ্গ কেন এল? জবাব খুঁজতে সময়ের চাকা ঘুরিয়ে যাওয়া যাক প্রায় দুশো বছর আগে। ১৮২২ সালের অক্টোবর মাস। আশ্বিনের শারদপ্রাতে দেবীর আগমনবার্তা শোনা যাচ্ছে কলকাতায়। ইংরেজরা তখন ভারতে ঢুকে পড়েছে। পলাশির যুদ্ধ পেরিয়ে নিজেদের রাজার আসনেও বসিয়ে ফেলেছেন। এমন সময় সেই সময়ের অন্যতম বিখ্যাত পত্রিকা ‘সমাচার দর্পণ’-এর একটি খবরের দিকে সবার নজর পড়ল। তাতে লেখা, হাওড়ার শিবপুরে নাকি লটারি করে দুর্গাপুজোর আয়োজন করা হচ্ছে! কস্মিনকালেও এমন কথা শোনেনি বাঙালি। লটারি কেটে পুজো! এ আবার কেমনতর?
সেই সময় হাওড়া এবং শিবপুরের ছবিটা একটু আলাদা ছিল। আজকের মতো পুরোদস্তুর শহর ছিল না এই অঞ্চল। এমনও দেখা গেছে, কলকাতার কোনো অপরাধীকে নৌকা করে ওপারে হাওড়ায় ছেড়ে আসা হয়েছে। সেখান থেকে ফেরার আর কোনো সুযোগ নেই। কাজেই, কলকাতার মতো ঐশ্বর্য, জাঁকজমক সেখানের মানুষ প্রত্যক্ষই করেনি তখন। কিন্তু দুর্গাপুজো করতে তো তাঁদেরও ইচ্ছা করে! কিন্তু কী করে করবেন! এত টাকা কোথা থেকে পাবেন তাঁরা? শেষ পর্যন্ত আসরে নামলেন গ্রামেরই কয়েকজন যুবক। তাঁদের প্রস্তাব, লটারি করে দুর্গাপুজো করা হোক। লটারি করে টাউন হল তৈরি হতে পারে, আর একটা পুজো হবে না!
ব্যস, আর কি! পরিকল্পনা তো সামনেই, এবার মাঠে নেমে পড়লেই হয়। আর লটারি চিরকালই মানুষের কাছে লোভনীয় এক বিষয়। টিকিট ছাপার পর বেশিক্ষণ লাগেনি ফুরিয়ে যেতে। হিসেব বলে, প্রায় দু’শো পঞ্চাশ টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছিল, যা ওই বাজারে অনেক বেশি। ঠিক হল, লটারিতে যিনি প্রথম হবেন, তাঁর নামেই পুজোর সংকল্প হবে। ওই টাকা দিয়েই শেষ পর্যন্ত শিবপুরে হয়েছিল দুর্গাপুজো। এরকম অদ্ভুত উপায়ে দুর্গাপুজোর রীতি এর আগে বাঙালি দেখেনি। এর পরেও কি দেখেছিল? জানা নেই…
তথ্যসূত্র- সাবেক কলকাতার ইতিহাস/ জলধর মল্লিক
Powered by Froala Editor