সপ্তমীর বিকেলের মেঘ নেমে এসেছে শামিমার মুখে। একটা আচমকা বদলাতে থাকা মফস্বলে ভিড় করে আসা বহুজাতিক সংস্থার কাঁচের বিপণন ঘরের সামনে একটা টুল আর টেবিল নিয়েই শামিমার ‘ওয়ার্কস্পেস’। কাজ, রান্নাঘরের জন্য আধুনিক চিমনি বিক্রি করা। “পুজোতে ছুটি নেই?” জিজ্ঞেস করলে নিয়মমাফিক হাসি ভেসে আসে। “আসলে লকডাউনের সময় ব্যবসা একদম হয়নি তো, টার্গেট মিট করা যায়নি দাদা। আপনি কি নেবেন? নিন না একটা। বাড়িতে মা’য়ের সুবিধা হবে।”
নিরাশ করে ফিরে আসতে হয়। বাটা জুতো কোম্পানির প্রথম কারখানা এশিয়ার বুকে তৈরি হয়েছিল এখানেই। বাটা সাহেবের ইচ্ছা অনুসারে জায়গার নাম হয়েছিল, বাটানগর। কিছু বছর আগেও দুটো বড়ো পুজোতে সরগরম হয়ে থাকত এলাকা। দিনেকালে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে সবখানে। পুজোর সেই রমরমা নেই, তাই ইদানিংকালে তরুণ প্রজন্ম পাড়ি দেয় শহরের অভিমুখে। শহুরে ‘থিম পুজো’র ঝড় এসে পড়েছিল স্থানীয়তেও। তবে এবছর মহামারীর ঠেলায় পুজো আবার ফিরে গিয়েছে সেই সাবেকিয়ানাতেই। খুশি স্থানীয় লোকজন। তার আভাস ধরা পড়ছে সোশ্যাল মিডিয়াতেও।
পুজো পরিক্রমার উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু একটা চলন ধরার জন্য পাড়ি দেওয়া গেল মফস্বল থেকে শহরের দিকে। অ্যাপ থেকে দু’চাকা বুক করতে ড্রাইভারের নাম এল, জায়েদ। জায়েদ মহম্মদ। যেতে যেতে বলল, “পুজো দেখবেন তো দাদা? কোথাও ঢুকতে দিচ্ছে না। কিন্তু আপনি চাইলে বলুন, একটু বেশি দেবেন, সাউথটা দেখিয়ে দেব। চ্যানেল আছে।” জিজ্ঞেস করা গেল, “ভিড় হচ্ছে কলকাতায়?” একদমই যে পুজো-পুজো ভিড় নয়, বোঝা গেল পরিষ্কার। একা প্রতিমা সুরক্ষার ঘেরাটোপে। প্যান্ডেলের পাশে বেলুন কিংবা খেলনা বাঘ-কুমির নিয়ে দাঁড়িয়ে মলিন নন্দ জোয়ারদার। কালিঘাট বস্তিতে বাড়ি। বিক্রি প্রায় হচ্ছেই না, জানালেন। “বাবা-মায়েরা তো কখনোই কিনে দিতে চায় না। বাচ্চারা বায়না করে বলেই...” মুখের মাস্কের ভিতরেও দীর্ঘশ্বাস বোঝা যায় স্পষ্ট। ছোটদের নিয়ে বেরোবার একটা হুজুগ প্রথম কয়েকদিন দেখা গেলেও, হাইকোর্টের রায়ের পরে লাগাম পড়েছে রাস্তায় বেরনোর। খাবারের রেস্তরাঁতেও লাইন পড়ছে না সেরকম। রাতের দিকে হাওয়ায় হিম বোঝা যাচ্ছে ভালোই। নতুন রিলিজ হওয়া বাংলা সিনেমার লাইন ধার করে বলাই যায়, শহরে বরফ পড়ার ইঙ্গিত কি?
আরও পড়ুন
যৌনপল্লীর শিশুদের নিয়েই ‘বসে আঁকো প্রতিযোগিতা’, পুজোয় ব্যতিক্রমী দৃশ্য কলকাতায়
মফস্বলেও রাস্তাঘাটে ভিড় যে একদমই হচ্ছে না, তা নয়। কিন্তু জমায়েত দেখলেই দোতলার ছাদ বা ব্যালকনি থেকে প্রচ্ছন্ন সতর্কবার্তা শুনিয়ে হুমকি দিচ্ছেন কেউ কেউ। “তোমরা তো বেঁচে যাবে বাবারা, কিন্তু বাড়িতে বাবা-মা আছে, সেই খেয়াল আছে একটুও?” ষষ্ঠী অবধি শহর থেকে যেসব বাস ফিরেছে মফস্বলে, তাতে বাদুড়ঝোলা ভিড়। অফিস-কাছারি সবই প্রায় ছুটি পড়ছে সপ্তমী থেকেই। লোকাল ট্রেন চালু হয়নি বলে বিভিন্ন দিকে হা-হুতাশ শোনা গেলেও, তাতে এই ভিড় যে আরও লাগামহীন হত আরও, সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু বাসের ভিড় আর নিত্যযাত্রীদের দুরবস্থা দেখে, ভয়ে ভয়ে হলেও লোকাল ট্রেন চালু করার দিকেই মন ঝুঁকে থাকছে কেমন যেন।
এই আবহে কোনো এক পুজো সংস্থার মাইক থেকে ভেসে আসা পথ সুরক্ষা ক্যাম্পেনের ‘নিজেকে বাঁচুন, অন্যকে বাঁচান’ বার্তা শুনতে লাগে অন্যরকমভাবে অর্থবহ। এই মফস্বলের শিরায় শিরায় লুকিয়ে থাকা অলিগলিতে আরও বেশ কিছু বারোয়ারি পুজো হয় ছোটখাটো। কম-কম আলো ছড়ানো পথেই দেবী বন্দনার মঞ্চ প্রস্তুত হয়। দেখা যায়, আরাধনার আগে একমনে মাথা নিচু করে ছোবড়া-ধুনোর জোগাড় করছে চাপা রং মেয়ে। তার উল্টো দিকের পোস্টার থেকে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে আনা স্পনসরের ছবিতে ‘সোয়্যাগ’ দেখিয়ে ঢাক বইছেন বরুণ ধাওয়ান। মাঝের রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে কিছু দু’চাকা এগিয়ে যাচ্ছে প্রেমিক-প্রেমিকা নিয়ে। চাপা রঙের কাছে সপ্তমী পিছনে ফেলে অষ্টমী পড়ার বেলা চলে আসে। মনে মনে কি ভাবছে ও? যার জন্য অপেক্ষা করে আছে, তার কথা?
আরও পড়ুন
পুজোর দিনগুলিতে করোনা সংক্রমণের বৃদ্ধি রাজ্যে, আমরা ওয়াকিবহাল তো?
স্থানীয় বড়ো পুজো যেখানে হয়, সেখানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ স্পষ্ট। সামাজিক দূরত্ববিধিকে কাঁচকলা দেখিয়ে এই আবহেও মেলার দোকান বসানোর অনুমতি মিলেছে। কিন্তু বিক্রির অবস্থা কেমন? জিজ্ঞেস করলে উত্তর আসে ক্লিশে, “দেখতেই তো পারছেন...” আইসক্রীম বা কোল্ডড্রিঙ্কসের দাম সাধারণ দোকানের থেকে মেলার স্টলে বেশ খানিকটা বেশি। একটু খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলে বেরিয়ে আসে এমন একটা ‘ওপেন সিক্রেট’, যেটা নিয়ে কথা বলা একদমই বারণ। লাভের বখরার হিসেব পরিষ্কার হয় খানিকটা। কিন্তু আশেপাশেই যে স্থায়ী দোকানগুলো আছে, সেখানে তো দাম বেশি নয়? তাহলে স্টলের বদলে ওখান থেকেই যদি কেনে সকলে? উত্তর আসে না পুজোর কদিন একটু বেশি রোজগারের আশায় নিজের নিজের সাকিন ছেড়ে বেপাড়ায় দোকান দেওয়া মানুষগুলোর থেকে। অর্থনীতিতে যে ঠিক কতটা ধাক্কা দিয়েছে করোনা মহামারী, এই উৎসব আরও স্পষ্ট করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সেটা। খালি চোখেই বোঝা যাচ্ছে গরীব মানুষগুলোকে নিয়ে হয়ে চলা রাজনীতিও।
আরও পড়ুন
নামাজ দিয়েই শুরু দুর্গার আরাধনা; আরামবাগের ঐতিহ্যবাহী পুজোয় মিশে সম্প্রীতির সুর
বন্ধ রেল স্টেশনে আড্ডা বসে প্রবীণদের অষ্টমী বিকেলে সান্ধ্যভ্রমণ শেষে। সকলের মুখে মাস্ক। দূরত্বও যথেষ্ট একে অপরের মাঝে। দূরে কোনও প্যান্ডেল থেকে মুকেশ ভেসে আসছেন। আলোচনা গড়াল এই অর্থনীতি আর সরকারের সদিচ্ছাকে কেন্দ্র করে। একদলের মত, পুজো না হলে কী করত এই সব ছোট ব্যবসায়ীরা? কী করত মৃৎশিল্পীরা? করোনাতে জীবন না গেলেও, পেটের টানেই তো যেত সেটা! আরেক দল এই যুক্তিকে সমর্থন করলেও, পুজো হওয়ার যুক্তিকে সমর্থন করছেন না। বক্তব্য, পুজো না করে সমস্ত পুজো কমিটির থেকে এবারের পুজোর বাজেট এক করে একটা ফান্ড তৈরি করাই যেত। তারপর সমস্ত শিল্পী, ব্যবসায়ীদের একটা তালিকা তৈরি করে সেই সাহায্য পৌঁছে দেওয়া যেত তাঁদের কাছে। টিপ্পনী ভেসে আসে অবিলম্বে, আমফানের ক্ষতিপূরণের টাকাই তারা পেয়েছে কিনা এখনও কে জানে!
সেই টাকা পাওয়া না পাওয়ার বিতর্কের মাঝেই এটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, ঢাকিদের বরাত কিন্তু কমেছে দেদার। সন্ধিপুজোর আরতি ম্যানেজ হচ্ছে রিপ্লে চলা ঢাকের শব্দ দিয়ে। ছোট কিন্তু বনেদী এবং বহু প্রাচীন একটি পুজোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাদের ঢাকি আসে মেদিনীপুর থেকে। কিন্তু এবার পুজোর বাজেট কম হওয়ায় তাদেরকেও কাজ চালাতে হচ্ছে ডাউনলোড করা ঢাকের বাদ্যি পেনড্রাইভে ভরেই। সেই সঙ্গেই চিনা জিনিস যতই ‘ব্যান’ করার জন্য আন্দোলন হোক না কেন সোশ্যাল মিডিয়ায়, রাস্তা-ঘাট কিন্তু সেজে উঠেছে সেই চিনা আলোতেই।
যদিও আলো আসেনি ভরা উঠোনের চেনা ছবিতে। সাবেকি পুজোতেও সেই চেনা ভিড় আর নেই। স্থানীয় বনেদি জমিদারবাড়ির অনেকেই থাকে হয়তো বাইরে। শরিকি বিবাদে ভাঙতে ভাঙতে তা এখন টুকরোতে এসে ঠেকেছে। অনেকে এসে পৌঁছতেও পারেনি এই পরিস্থিতিতে বাইরে থেকে। জানালায় বসে থাকা বৃদ্ধার মুখ প্রতীকি হয়ে থাকে খুব। সেই কবে থেকে তো বন্দি হয়ে আছি আমরাও!
তবে আন্তরিকতাতে ঘাটতি নেই কোথাও। একদিকে যেমন চলছে পুজোর ভোগ কী করে তৈরি হবে আর কী করে সেটা পৌঁছে দেওয়া হবে বাড়িতে বাড়িতে তার প্রস্তুতি, তার সঙ্গেই মহিষাসুর বধের সঙ্গে বসে আঁকো প্রতিযোগিতার বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে করোনা বধের প্রসঙ্গও। পিন দিয়ে প্যান্ডেলের পাশের দড়িতে এঁটে দেওয়া হয়েছে কচিকাঁচাদের আঁকা করোনাসুর বধের ছবি।
তবে মফস্বলের ভিতরটায়, যেখানে মাটির গন্ধ আরও খানিকটা বেশি, সেখানে ছোটো ছোটো পুজো হত বেশ কয়েকটা। দেখা মিলল না অনেকগুলোরই। পুজোর অষ্টমীর সন্ধেতে শহর থেকে মাত্র ঘণ্টাখানেক দূরের শহরতলির এইসব জায়গাগুলোতে তখন চাপচাপ অন্ধকার; নিস্তব্ধতা। একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। নবমী শেষ হতে চলল। না হইয়ো অবসানের আকুতি আর কয়েক প্রহর পরেই। শেষ বেলায় মাথায় প্লাস্টিকের খেলনা, ছোটোদের সস্তার জামাকাপড়ের ঝাঁকা নিয়ে ফিরছে রোগাসোগা পিতা। পাশে প্যান্টের পকেট ধরে ফ্রক পরা ছোট্ট মেয়ে। সস্তার মদের সঙ্গে ভেসে আসে একটানা অসহায় বিলাপ, “আর দু’দিন একটু ব্যবসা দে মা! আর দু’দিন একটু—” যে মসজিদে আলো পড়েছে হিন্দু দেবীর পুজোর, তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল চিরকালীন পিতা-কন্যা...
Powered by Froala Editor