পাকিস্তান আর আরবে দুর্গাপুজো, উর্দুতে লেখা চণ্ডীমন্ত্র

দুর্গার বিদেশভ্রমণ - ২

কুমোরটুলি থেকে দেশ-বিদেশে প্রতিবছরই পৌঁছে যান মা দুর্গা। ইউরোপ, আমেরিকার দেশগুলিতে তো বটেই, এমনকি আফ্রিকার কোনো-কোনো দেশেও তাঁর বিচরণ। যেখানে বাঙালি, সেখানেই তিনি। কিন্তু এই এশিয়ারই এমন দুটি দেশে দুর্গাপূজা হয়, যা আমরা চট করে ভাবতে পারি না। প্রথমবার শুনেও অবাক হতে হয়। আসুন আজ জেনে নিই তেমনই কিছু দেশের কথা।

আরও পড়ুন
কেন মুখ ফেরাচ্ছে নতুন প্রজন্ম? কুমোরটুলির ভবিষ্যৎ কি তবে রপ্তানিই?

মা দুর্গার আগমনে পেছিয়ে নেই আমাদের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানও। চমকে উঠবেন না। হ্যাঁ, পাকিস্তানেও দুর্গাপুজো হয়েছিল। ২০১৩-য় করাচিতে দেড়শো বছরের পুরোনো স্বামীনারায়ণ মন্দিরে দেবী দুর্গার আরাধনার ব্যবস্থা করেছিলেন সেখানকার হিন্দুরা। অভিনবত্বের দিক থেকে বিদেশের অন্যান্য পুজোর থেকে পিছিয়ে ছিল না সেই পুজো। ৭০ লাখ হিন্দুর বাস পাকিস্তানে। বেশিরভাগই সিন্ধি। এখানকার হিন্দুরা হিন্দি এবং সংস্কৃত ভাষায় কম পারদর্শী। সেই বাধার কাছেও হার মানেননি তাঁরা। সমস্ত সংস্কৃত মন্ত্র তাঁরা উর্দুতে লিপিবদ্ধ করেছেন। ‘লাহোরের মত শহরগুলোয় উর্দুতে লেখা গীতা পাওয়া যায়। পাকিস্তানে সংস্কৃতের মতো ভাষা শেখার সুযোগ কম’—বক্তব্য পাকিস্তানের হিন্দু কাউন্সিলের সেক্রেটারি হরিশ মাখানির। স্বামীনারায়ণ মন্দিরে দীপাবলি, দশেরা, জন্মাষ্টমীর মতো অনুষ্ঠানের পাশাপাশি এই দুর্গাপুজোর শুরুও সেখানেই। হিন্দু কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট এবং বিখ্যাত শিল্পপতি জেঠানন্দ দুঙ্গারমল কোহ্‌-ই-স্তানি বলেন, ‘প্রতি বছর পাকিস্তানে আমরা ধুমধাম করে দশেরা পালন করি।’

পাকিস্তানে দুর্গাপুজো

এবার একটু মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলির দিকে তাকানো যাক। সংযুক্ত আরম আমিরশাহী (ইউএই) যেহেতু মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের দেশ, সেখানে মূর্তিপূজা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ বাঙালির পরিবারের বাস এখানে। বাঙালি থাকবে অথচ দুর্গাপুজো হবে না তা কীভাবে হয়? একদিকে কঠোর আইন অন্যদিকে আবেগ। কিন্তু বাঙালিকে কে আর কবে আটকে রাখতে পেরেছে। বিখ্যাত মগজাস্ত্রের জোরে এখানেও বাঙালির বাজিমাত। ফেলুদা সুলভ মগজাস্ত্র নিয়ে এগিয়ে এলেন আর্ট ডিরেক্টার দেবাশিস মান্না। সঙ্গী দুজন বাঙালি মেয়ে। মহুয়া চক্রবর্তী এবং মৌসুমী মুখোপাধ্যায়। তিনজনে মিলে এঁকে ফেললেন সাঙ্গপাঙ্গ-সহ দুর্গার রূপ। মূর্তিপূজার নিয়ম না-ই থাকতে পারে, ছবি পুজোয় নিষেধ নেই। অসাধ্য সাধন করলেন তিন বাঙালি, ছবি আঁকার কোনরকম প্রফেশনাল ট্রেনিং ছাড়াই। এঁরা কিন্তু কেউ কস্মিনকালেও ভারতে আসেননি। জন্ম ও বেড়ে ওঠা আবুধাবিতেই। তৈরি করলেন বঙ্গ বাহিনী।  কারোর কাছে কোনোরকম অর্থ সাহায্য না চেয়ে শুরু হল পুজো। একটি বন্ধ অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যে। আবুধাবিই আরব এমিরেটসের একমাত্র শহর যেখানে দুর্গাপুজো হয়। গৌতম মণ্ডল, সুদীপ চক্রবর্তী, গৌরদাস ব্যানার্জি, অলোক মাইতি, শুভাশিস চ্যাটার্জি, মানস দাস মিলে তৈরি করলেন পূজা কমিটি। শুরু হয় আজ থেকে একত্রিশ বছর আগে, ১৯৮৫ সালে। সেই সময় আবুধাবিতে প্রথম যে ক’জন বাঙালি ছিলেন তাঁদের একজন দিলীপ রায়। তাঁর বাড়িতেই শুরু হয় এই পুজো। পরপর ৩ বছর তাঁরা এভাবেই চালিয়ে যান, যতক্ষণ না সরকারিভাবে অনুমতি পাচ্ছিলেন আরো বড়ো করে পুজো করার। ‌

দুবাই-এর দুর্গাপুজো

এরপর পুজো শুরু করে সেখানকার ইন্ডিয়ান সোশ্যাল ক্লাব। সে এক জমজমাট ব্যাপার। মরুভূমিতে বাঙালিদের জন্য তৈরি হয়েছিল মরুদ্যান। সারা মধ্য প্রাচ্য জুড়ে উৎসাহিত হয়ে উঠেছিল বাঙালিরা। আশেপাশের দেশ বাহরিন, ওমান থেকেও বাঙালিরা ছুটে এসেছিল এই পুজোয় যোগ দিতে। কিন্তু ১৯৯০ সাল নাগাদ হঠাৎই নানা কারণে বন্ধ হয়ে যায় পুজো।

তারপর প্রায় এক যুগ বন্ধ ছিল পুজো। অবশেষে আরব এমিরেটসের সমস্ত বাঙালিরা একজুট হয়ে তৈরি করে এক অ্যাসোসিয়েশন। নাম আহবংস (AUHBONGS)। শুরু হয় নতুন করে দুর্গোৎসব। উদ্যোগী ছিলেন আবুধাবির একজন বিশিষ্ট উদ্যোগপতি ড. বি আর শেঠী। তিনি নিজের উদ্যোগে আবুধাবির মন্ত্রিসভা থেকে প্রয়োজনীয় অনুমতি যোগাড় করেন। নিজের হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েট হলটি দেন পুজোর জন্য। এই পুজোর প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিস আসে কলকাতা থেকে। মূর্তির বদলে কখনো পেন্টিং বা গ্লাস পেন্টিং-এ মা দুর্গা ধরা দেন। ১৯৮৫ সালে যে পুজো বন্ধ অ্যাপার্টমেন্টে শুরু হয়েছিল মাত্র দু’শো পরিবারের মধ্যে, ২০১৬ সালে সেই সংখ্যাটা দাঁড়িয় প্রায় দশ হাজারের কাছাকাছি। এখন আর শুধু আরব আমিরশাহীতেই নয়, মধ্যপ্রাচ্যে বাঙালির পুজো ছড়িয়েছে ওমানের মাসকটসহ অন্যান্য দেশেও।

(ক্রমশ)

(কভারের ছবি - আবুধাবির দুর্গাপুজো)

More From Author See More

Latest News See More