ঢাকের বদলে ড্রাম, জমাটি দুর্গাপুজো সিংহের দেশ আফ্রিকায়

দুর্গার বিদেশভ্রমণ - ৪

এত দিন আফ্রিকা মানে আম বাঙালির কাছে ছিল নেলসন ম্যান্ডেলার দক্ষিণ আফ্রিকা। তারও আগে বিভূতিভূষণের হাত ধরে ‘চাঁদের পাহাড়’। ইথিওপিয়া মানেই দুর্ভিক্ষ, আবেবে বিকিলা বা হাল আমলের দিবাবা বোনেরা। কিন্তু বাঙালির সঙ্গে আফ্রিকার যোগাযোগ শুধু এটুকু নয়। কিন্তু বাঙালির সঙ্গে আফ্রিকার যোগাযোগ শতাব্দীপ্রাচীন।

আরও পড়ুন
পাকিস্তান আর আরবে দুর্গাপুজো, উর্দুতে লেখা দুর্গাপুজো

আফ্রিকার বং কানেকশন উনিশ শতকের শেষদিকে। ১৮৯৮ সাল নাগাদ কলকাতা থেকে স্ত্রী পুত্রসহ বসন্ত কুমার মিত্র নাইরোবিতে পৌঁছোন রেলের অফিসার হয়ে।  রেলওয়ে থেকে অবসরের পরে সেখানেই বি কে মিত্র এন্ড সন্স নামে একটি জেনারেল স্টোর খোলেন। বর্তমানে তাঁর বাড়ি আর দোকানটি নাইরোবির একটি জনপ্রিয় ল্যান্ডমার্ক ‘পাঙ্গানি বাড়ি’।  ১৯১৪ সালে বার্মা থেকে আরেক বাঙালি ব্রজমাধব ঘোষও রেলের চাকরি নিয়ে নাইরোবি পৌঁছোন। কথায় আছে যেখানে তিনজন বাঙালি জড়ো হয় সেখানে একটি দুর্গাপূজা শুরু হতে বেশি দেরি লাগে না। নাইরোবিতেও পুজোর শুরু হতে বেশি দেরি হয়নি। ১৯১৬-১৭ নাগাদ এখানে পুজোর শুরু। আরও পরে ১৯৫০ সালে তৈরি হয় বেঙ্গলি ওভারসিজ অ্যাসোসিয়েশন। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে নতুন প্রজন্মের পরিচয় এবং বাংলা ভাষা শিক্ষার জন্য ১৯৫২ সালে ‘বাণীমন্দির’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এখনো প্রত্যেক শনি রবিবার ক্লাস হয়। ১৯৯৮ সাল থেকে পুরনো নাইরোবির দুর্গাপূজা স্থানান্তরিত হয় মহারাষ্ট্র সেবা মণ্ডলের হনুমান ফিজিক্যাল কালচার ইনস্টিটিউটে।

জাম্বিয়ার দুর্গাপুজো

শুধু নাইরোবিতেই নয়, বর্তমানে আফ্রিকার অনেক জায়গাতেই দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এবং সেসবও অনেক পুরনো। তানজানিয়ার রাজধানী পূর্ব আফ্রিকার একটি ছোট দেশ দার এস সালেমের দুর্গাপুজো এবছর বিয়াল্লিশ বছরে পা দিল। সেখানকার বাঙালি অ্যাসোসিয়েশন ‘বঙ্গসংঘ’ বেশ জাঁকজমক করেই পুজো করে। সারা বছর ধরে প্রত্যেক পরিবারের কাছ থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী চাঁদা তোলা, সুভিনিয়ারের জন্য বিজ্ঞাপন জোগাড়, প্রত্যেকদিনের ভোগের জন্য স্পনসর জোগাড় সবই হয় প্রায় কলকাতার মতোই। আগে কার্ডবোর্ডের প্রতিমায় পুজো হত। পুজোর পর থাকত কোনো সদস্যের বাড়িতে। কলকাতা থেকে ঢাকি নিয়ে যাবার অসুবিধার জন্য পুজোর আরতি বা হোমের সময় এতদিন তারা আফ্রিকান ড্রামসেই বাজত দেশি ঢাকের বোল। ২০১৩ সাল থেকে বাংলার ঢাকের বন্দোবস্ত হয়েছে। সেটাও কম ঝামেলার ছিল না। কলকাতা থেকে ঢাক কিনে জাহাজে তোলা হয়। তিনমাস পরে নানা বন্দরে পাক খেতে খেতে  দার এস সালেমে পৌঁছয় সে বছর দুর্গাপূজার পর। তারপর কাস্টম ক্লিয়ারেন্স পেয়ে সেই ঢাক বাজে কালীপুজোর রাতে। নাইরোবিতে শুধু দুর্গাপূজা হলেও এখানে দুর্গা, লক্ষী, কালী, সরস্বতী প্রায় সব পুজোই করা হয়।

নাইজেরিয়ার দুর্গাপুজো

এতক্ষণ ধরে আফ্রিকায় ঘুরপাক খেয়ে হয়ত প্রশ্ন জাগছে, আফ্রিকায় দু’শো বছরের বাঙালি ইতিহাস হল, দুর্গাপূজা হল, কিন্তু কুমারটুলি আফ্রিকায় এল কই? এবার তাহলে কেনিয়া তানজানিয়া ছেড়ে যেতে হবে আফ্রিকার ছোট্ট দেশ জাম্বিয়ায়। আফ্রিকার দক্ষিণ দিকের এই দেশটি বিখ্যাত তার খনিজ সম্পদের কারণে। বিশেষত তামার জন্য। অন্যান্য ভারতীয়দের সঙ্গে বাঙালিরাও এই সব তামার খনিতে বেশ উচ্চপদেই রয়েছে। এখানকার বাঙালি কমিউনিটি কিটউই শহরে দুর্গাপূজা শুরু করে ১৯৮৫ নাগাদ। তারপর বহু বাঙালি এসেছেন, আবার ফিরেও গেছেন, কিন্তু দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর ধরে এই পুজো থামেনি। ২০০৬ সাল পর্যন্ত কিটউই শহরেই পুজো হয়। ২০০৭ সাল নাগাদ কুমারটুলি থেকে প্রথম শোলার প্রতিমা আসে এখানে, সেইসঙ্গে পুজো স্থানান্তরিত হয় চিঙ্গোলা শহরের কঙ্কোলা কপার মাইনসের জিওলজি বিভাগের প্রধান সৌম্যকান্তি সেনগুপ্তের বাড়িতে। ২০১১ অব্দি সেই প্রতিমাতেই পুজো হয়। ২০১২-তে আবার কুমারটুলি থেকে নতুন প্রতিমা আসে সুনীল পালের কাছ থেকে। এবারের প্রতিমা ফাইবার গ্লাসের। সেই প্রতিমাতেই এখনও পুজো চলছে। সৌম্যবাবুর কথায় ‘কলকাতা থেকে দূরে বসেও আমরা যথেষ্ট নিষ্ঠা ভরে সমস্ত রকম আচার পালন করেই পুজো করি। চণ্ডীপাঠ হয়, নবমীর দিন ১০৮টা প্রদীপ জ্বালানো থেকে ভোগ বিতরণ সমস্তই আচার মেনে পালন করা হয়। এভাবেই চলছে এখানকার পুজো। এভাবেই কলকাতার সঙ্গে আমরা নিজেদের জুড়ে রেখেছি।’

কেনিয়ার দুর্গাপুজো

পরবর্তীকাল খোঁজ নিতে নিতে চমকে উঠেছিলাম একটা তথ্য শুনে। ইথিওপিয়াতেও দুর্গাপুজো!  আবেবে বিকিলার দেশ। আফ্রিকার কোন প্রত্যন্ত একটা দেশ, সারা বিশ্ব যাকে গরিব দেশ বলে জানে সেখানেও দুর্গাপুজো হয় মহাসমারোহে। যোগাযোগ হয় ইথিওপিয়ার পুজা কমিটির প্রেসিডেন্ট কল্লোল দত্তের সঙ্গে। তিনি জানান, ‘ইথিওপিয়াতে বাঙালির সংখ্যা কম। অন্যান্য ভারতীয়দের সঙ্গে আমরা মিলেমিশে থাকি। বাঙালি হিসাবে নয়, এখানে আমরা ভারতীয় হিসেবেই দুর্গাপুজো করে থাকি। আমিই প্রথম আমাদের এখানকার ভারতীয় কমিউনিটিতে প্রস্তাব আনি পুজো করার। আমরা এখানে ৩ দিন পুজো করি। আসলে দেশের বাইরে এতটা দূরে থেকেও যতটা সম্ভব দেশের সঙ্গে একাত্ম থাকা যায়।’ আফ্রিকার শুধু দার এস সালেম, কেনিয়া, তানজানিয়া, ইথিওপিয়াতেই নয়, পুরো আফ্রিকা জুড়েই প্রচুর পুজো হয়। তার মধ্যে বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের পুজো, ডারবানে ১৯৪২ সাল থেকে শুরু রামকৃষ্ণ মিশন সেন্টারের পুজো, জাম্বিয়ার লুসাকা, উগান্ডার কাম্পালা শহরের পুজোও উল্লেখযোগ্য।

এসব জেনে গর্বিত হই বাঙালি হিসেবে। আমরা ছড়িয়ে আছি পৃথিবীর প্রত্যেক কোণাতেই। মহাসমারোহে পালন করি আমাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসব। বাংলায় না থেকেও, আমাদের ঐতিহ্য ছাড়তে পারেননি অনেকেই। বোলো দুর্গা মাই কি...

More From Author See More