চওড়া ফুটপাত আর কারুকাজ করা সুন্দর সব ঘাট— চন্দননগরের স্ট্র্যান্ড যেন এখনও পড়ে আছে সেই ফরাসি ইতিহাসে। গঙ্গার ধার ঘেঁষে হাঁটতে আরম্ভ করলে এক জায়গায় এসে চোখ টানতে বাধ্য আপনার। ঘাটের ধারে ছোট্ট একটা স্থাপত্য; ভেতরে পাতা বেঞ্চ আর বাইরের অপূর্ব কারুকাজ। এতসব দেখতে দেখতে চোখ পড়বে একটি ফলকের দিকে। যার স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত ঘাট, তাঁর নামেই ফলক। কিন্তু এ কেমন নাম! ‘মঁসিয়ে দৌরগা চারণ রাকুইট’! নিশ্চয়ই কেউকেটা ছিলেন এই শহরের!
আজ বাঙালির ইতিহাস এই নামকে হয়ত সেভাবে মনে রাখে না। কিন্তু চন্দননগরের ইতিহাসের সঙ্গে ইনি জড়িয়ে আছেন ওতপ্রোতভাবে। এই ‘দৌরগা চারণ রাকুইট’-ই প্রথম ভারতীয় যিনি ফ্রান্সের ‘লিজিয়ঁ দ্য অনার’ সম্মানে সম্মানিত হয়েছিলেন। ভারতীয় তো বটেই, খাঁটি বাঙালিও। দুর্গাচরণ রক্ষিত চন্দননগরের এক জলজ্যান্ত কিংবদন্তির নাম, যা আজও জেগে আছে প্রবলভাবে। তাঁর সঙ্গেই জেগে আছে এখানকার সবার আপন ‘স্ট্র্যান্ড’…
কে ছিলেন এই দুর্গাচরণ রক্ষিত? এক কথায় বলতে গেলে, উনবিংশ শতকে চন্দননগরের এক সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী। বাঙালি ব্যবসা বোঝে না— এই মন্তব্যের বিরুদ্ধে যে সমস্ত নাম রুখে দাঁড়ায়, দুর্গাচরণ রক্ষিত তাঁদের মধ্যে অন্যতম। স্রেফ ব্যবসা ও বুদ্ধির জোরে শুধু চন্দননগর বা বাংলা নয়, বিশ্বের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর নাম। চন্দননগরের লাল বাগানে আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর বিশাল ‘রক্ষিত ভবন’। ভেতরে ঢুকলে সেই ইতিহাসের একটা স্পর্শ তো পাওয়া যায়ই। সেই সঙ্গে উঠে আসে আরও নানা গল্প। শুধুমাত্র ব্যবসায়িক গণ্ডিতে আটকে থাকেননি তিনি; দুর্গাচরণ রক্ষিতের গল্প আরও বড়ো ছবি নিয়ে হাজির হয় আমাদের সামনে।
প্রায় সমগ্র বাংলা ও ভারত তখন ব্রিটিশদের অধীনে। আর ব্রিটিশদের কাছে সেই সাম্রাজ্যের সোনার শহর হল কলকাতা। আর তারই পাশে বেড়ে উঠছিল ফরাসিরা। তাঁদের সবেধন নীলমণি যে কয়টি জায়গা, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান হল চন্দননগর। শহরের ম্যাপটা দেখলে মনে হবে অনেকটা চাঁদের মতো আকৃতির; সেখান থেকেই প্রথমে নাম হয়েছিল ‘চাঁদেরনগর’। উনবিংশ শতকেও ব্রিটিশ আর ফরাসিদের মধ্যে উপনিবেশ নিয়ে লড়াই চলছিল। কিন্তু পণ্ডিচেরি, চন্দননগরের মতো জায়গাগুলি থেকে ১৯৫০ সালের আগে তাঁদের সরানো যায়নি। এমনই একটি শহরে পরিবারের সঙ্গে হাজির হলেন ছোট্ট দুর্গাচরণ। গ্রামের বাড়ি ভাণ্ডারহাটি থেকে চলে আসা এখানে, বাকি কাহিনিটা তৈরি হয় চন্দননগরের বুকেই।
দুর্গাচরণের পারিবারিক ব্যবসা ছিল তাঁতের। তবে তাঁর বাবা গোবিন্দচন্দ্র রক্ষিত সেই ব্যবসার পথে পা বাড়াননি। কামা লামোর অ্যান্ড কোং নামের এক ফরাসি কোম্পানিতে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। ধীরে ধীরে নিজের পরিশ্রমের জোরে মুৎসুদ্দির পদেও পৌঁছন তিনি। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে অল্প বয়সেই মারা যান। ১২ বছরের দুর্গাচরণের ওপর সংসারের দায়দায়িত্ব এসে পড়ে। তখনই এগিয়ে আসেন কামা লামোর কোম্পানির মালিক মসিয়ে কামা। তাঁরই চেষ্টায় ফরাসি শেখা শুরু দুর্গাচরণের। পরে মাত্র ১৪ বছর বয়সে কামা লামোর অ্যান্ড কোং-এ সহকারী কোষাধ্যক্ষের পদে কাজ করতে আরম্ভ করেন।
চাকরি ঠিক দুর্গাচরণের রক্তে ছিল না। পারিবারিক ব্যবসার দিকেই তাঁর ঝোঁক। ফরাসডাঙার বিখ্যাত তাঁতকে আশ্রয় করে নিজের ছোট্ট ব্যবসা শুরু করলেন তিনি। তখনও কি জানতেন, ভাগ্য তাঁকে কোথায় নিয়ে যাবে! নিজের বুদ্ধি, পরিশ্রম ও দক্ষতার জেরে অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠল। নিয়ম মেনে চলত তাঁর জীবন। আর এই নিয়মের জেরেই একসময় তাঁর নাম উঠে এল খবরের কাগজের পাতায়। এখান থেকে বিদেশে পাঠাতেন চা, ডাল, কাপড়, আফিম-সহ নানা দ্রব্য; বদলে বিদেশ থেকে তাঁর কাছে আসত দামি ফরাসি মদ, কুইনাইন, জিঙ্ক হোয়াইট ইত্যাদি। চন্দননগর থেকে একসময় গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর নাম। শুধু ফ্রান্সই নয়; মালয়েশিয়া, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, জামাইকা, হংকং, মরিশাস, মিশরের মতো জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। একটু একটু করে উনবিংশ শতকে বাংলা ও ভারতের ব্যবসার জগতে রীতিমতো দৈত্য হয়ে উঠলেন এক বাঙালি। একসময় এমন হল যে ব্যবসার কাজে নিজের জাহাজ রাখতে হল দুর্গাচরণকে। বেশ কয়েকজন বিদেশিকেও নিয়োগ করেছিলেন অফিসে।
আরও পড়ুন
পরপর পাঁচজনকে নৃশংস খুন, কলকাতার প্রথম সিরিয়াল কিলার এক মহিলা!
এইভাবেই দুর্গাচরণ রক্ষিত থেকে ‘মসিয়ে দৌরগা চারণ রাকুইট’-এর যাত্রা। রক্ষিত ভবনে এখনও যত্নে রয়েছে তাঁর ব্যবহার করা চিঠিপত্র, জিনিস, ঘর। সাহেবদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তৈরি করেছিলেন আলাদা একটা ঘর, ‘সাহেবি বৈঠকখানা’। তবে ব্যবসাতেই থেমে থাকে না দুর্গাচরণ রক্ষিতের জীবন। চন্দননগরকে প্রাণভরে ভালোবাসতেন, সেখানকার উন্নতির জন্য অনেক দান-ধ্যানও করেছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজ সমস্ত দিক দিয়ে যাতে এই শহরটার উন্নতি হয় সেইজন্য ভাবতেন। গরীব মানুষদের জন্য বিনামূল্যে ওষুধের দোকান খুলেছিলেন তিনি; এমনকি বিনামূল্যে চাল-ডালের বন্দোবস্তও করেছিলেন। ১৮৮৫ সালে ‘একল দুর্গা’ নামে একটি স্কুলও চালু করেন তিনি। আজ সেই স্কুলের নাম ‘দুর্গাচরণ রক্ষিত বঙ্গ বিদ্যালয়’।
ফরাসি সরকারের তরফ থেকে সম্মানও পেয়েছেন অনেক। একটা সময় চন্দননগরের মেয়র ও গভর্নরও হয়েছিলেন দুর্গাচরণ রক্ষিত। স্থানীয় আদালতের বিচারকের ভূমিকাও পালন করেছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ১৮৯৬ সালের ৬ জুন ফরাসি সরকারের তরফ থেকে তাঁকে ‘লিজিয়ঁ দ্য অনার’ সম্মানে সম্মানিত করা হয়। সত্যজিৎ নন, দুর্গাচরণ রক্ষিতই ছিলেন প্রথম ভারতীয় ও বাঙালি যিনি এই সম্মান লাভ করেন। ১৮৯৮ সালে বেনারসে তাঁর মৃত্যুর পর গোটা চন্দননগর স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফরাসি সরকারও তাঁর শেষ সম্মানের জন্য মণিকর্ণিকা ঘাটে একটি রেজিমেন্ট পাঠান। শেষ মুহূর্তে চেয়েছিলেন চন্দননগরের গঙ্গার তীরে একটা সুদৃশ্য ঘাট তৈরি করা হোক। তাঁর জীবিতাবস্থায় না হলেও, ১৯২১ সালে দুর্গাচরণের পুত্র শ্যামাচরণ রক্ষিত একটি ঘাট তৈরি করেন। আজ যা স্ট্র্যান্ডের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। ইতিহাস কীভাবে আচরণ করেছে সেটা পরের কথা। কিন্তু চন্দননগর তার এই কৃতি সন্তানকে মনে রেখেছে আজও। পুরনো দিনগুলোর কথা এত সহজে কি ভোলা যায়!
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
পোলিও নিয়ে গবেষণার স্বীকৃতি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় বাঙালি বিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা