সমুদ্রের নিচে আজও লুকিয়ে ইংল্যান্ডের প্রাচীন জনবসতি ডানউইচ

একসময় সুখ-সমৃদ্ধি সবই ছিল। মানুষরা খুশিমনে থাকত, আনন্দ বৈভব সবই ছিল হাতের সামনে। শহরটাও বাড়ছিল একটু একটু করে। এককথায়, রীতিমতো জমজমাট ছিল গোটা চত্বর। কিন্তু সময় কি সবার একরকম থাকে? ধ্বংসের মুখে পড়ল একসময় সবটা। ধীরে ধীরে সলিলসমাধি হল একটা আস্ত শহরের। এরকমই কাহিনি ইংল্যান্ডের ডানউইচ গ্রামের।

ইংল্যান্ডের সাফোক কোস্টাল এলাকার ছোট্ট একটি প্রান্তিক গ্রাম ডানউইচ। ছোটো ছোটো বাড়ি, গাছপালা, নীল আকাশ— সব মিলিয়ে ছবির মতো পরিবেশ। সেখানেই মাঝে মাঝে রয়েছে কিছু পাথরের স্তূপ। গঠন দেখলেই বোঝা যায়, এগুলো এমনি এমনি তৈরি হয়নি। এককালে বড়ো কোনো স্থাপত্যের অংশ ছিল। বাস্তবিকই তাই। কোনোটা ছিল চার্চ, কোনোটা আবার হাসপাতাল। এসবই ছিল এককালের সমৃদ্ধ ডানউইচের অংশ। অবশ্য স্থলে সেসবের নিদর্শন বড়ো অল্পই রয়েছে। বেশিভাগটাই সমুদ্রের নিচে ডুবে আছে আজও।

ইতিহাস বলে, রোম সাম্রাজ্যের সময় থেকেই এই অঞ্চলের অস্তিত্ব ছিল। প্রথমদিকে অল্প লোকসংখ্যা থাকলেও, আস্তে আস্তে সেসব বাড়তে থাকে। একদিকে সমুদ্র, পাশে ব্লিথ নদী; জনবসতির জন্য আদর্শ। অ্যাংলো-স্যাক্সন পিরিয়ডেই ডানউইচ একটি বন্দর শহর হিসেবে পরিচিত ছিল। আস্তে আস্তে বন্দর আর ব্যবসার পাশে আরও একটা জিনিস এখানে এসে মেলে। খ্রিস্ট ধর্ম। ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে রাজা সিগবার্থ পূর্ব অ্যাঙ্গলিয়ায় ফেরত এলে ওই এলাকায় খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের জন্য মিশনারিদের পাঠাতে থাকেন। সেই সময়ই ডানউইচেও প্রবেশ করে তাঁরা। আস্তে আস্তে শহরে তৈরি হয় গির্জা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। আরও বেড়ে ওঠে সীমানা। আনুমানিক ৮৭০ খ্রিস্টাব্দের আশেপাশের সময় ডানউইচ খ্রিস্টীয় উপাসনার অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে সামনে আসে।

তবে বাণিজ্য হারিয়ে যায়নি কখনই। বরং এটাই ছিল ‘লাইফলাইন’। ইউরোপের অন্যান্য জায়গা তো আছেই, আইসল্যান্ডেও পৌঁছে গিয়েছিল ডানউইচের জাহাজ। যত বাণিজ্য বাড়তে থাকে, সমৃদ্ধি ততই ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। আস্তে আস্তে তৈরি হয় ১৯টি চার্চ; সঙ্গে চ্যাপেল, মনাস্ট্রি, হাসপাতাল। এখনকার লন্ডনের যেমন বিস্তৃতি, প্রায় সেরকম জায়গাতেই পৌঁছে গিয়েছিল ডানউইচ। সব মিলিয়ে একটা অন্য উচ্চতায় পৌঁছে যায় শহরটি। আর তারপরই শুরু হয় ধ্বংসের খেলা…

মোটামুটি ১২৬৮ সাল থেকে ডানউইচের সমৃদ্ধি নিচের দিকে নামতে থাকে। একের পর এক ঝড় শহরের ভিত নাড়িয়ে দিয়ে যায়। এর পাশাপাশি এইসবের ফলে সমুদ্র সৈকতেরও ক্ষয় হতে আরম্ভ করে। এই জিনিসটাই শেষ ডেকে আনে ডানউইচের। তারই মধ্যে ব্লিথ নদীরও গতিপথ বদলে যায়। একদিন যে বন্দর সমৃদ্ধির কেন্দ্রে ছিল, সেটি চলে যায় জলের তলায়। আস্তে আস্তে শহরেরও একটা বড়ো অংশের জায়গা হয় সেখানে। জলের তলাতেই চলে যায় সব। তাও যে জায়গা মাটির ওপর বেঁচেছিল, সেখানে কিছু মানুষ থাকছিল। ১৪-শ শতকে তাঁরাও চলে যায় ডানউইচ ছেড়ে। এককালের ভরা শহর শ্মশানে পরিণত হয়।

তারপর কেটে গেছে বহু বছর। ডানউইচ আজ ইংল্যান্ডের ছোট্ট একটি গ্রাম। কিন্তু ইতিহাস? তাকে তো অস্বীকার করা যায় না। সমুদ্রের নিচে আজও নিমজ্জিত রয়েছে সেই পুরনো ডানউইচের বিধ্বস্ত নিদর্শন। যার কিছু চিহ্ন ওপরেও আছে। এভাবেই, ইতিহাস ও বর্তমানকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে এই ছোট্ট ডানউইচ।

More From Author See More