‘চা পানের উপকারিতা’ – ব্রিটিশ আমলের যে বিজ্ঞাপন আজও রয়েছে দমদম স্টেশনে

ক্যামেলিয়া সিনেনসিস। এরকম কঠিন নাম বললে অনেকেই হয়তো বুঝতে পারব না। কিন্তু এরই একটা ডাকনাম আছে, যার সঙ্গে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকে একাত্ম হয়। চা। হ্যাঁ, বাঙালি হোক বা চিনা, চা ছাড়া দিনটা অনেকে ভাবতে পারেন না।

তবে প্রথমদিকে ভারতে চায়ের যাত্রাপথ যে খুব মসৃণ ছিল, তা বলা যাবে না। ভারতের বুকে চিনে জন্মানো এই পানীয়ের হদিশ পাওয়া যায় বৌদ্ধ আমল থেকেই। তবে সেরকমভাবে হয়ত লোকসমাজে ছড়িয়ে পড়েনি এটি। এ দেশে ব্যাপকভাবে চা প্রচলন করার কারিগর ছিল ব্রিটিশরা। আসাম ও উত্তরবঙ্গ— যে দুটি জায়গাকে চায়ের স্বর্গ বলা হয়, সেখানে চা চাষ শুরু করেছিল এই ব্রিটিশরাই। তবে তখনও আম বাঙালির জীবনে সম্পূর্ণ জড়িয়ে যায়নি এটা। আর ঠিক তখন থেকেই চায়ের অভিনব বিজ্ঞাপনের ওপর জোর দিতে থাকে ব্রিটিশরা।

দমদম স্টেশনে যাদের যাতায়াত, তাঁরা এখনও দুই-তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে গেলেই চিনে নেবেন একটা দোকানকে। চায়ের দোকান। কিন্তু দোকানের দিকে তাকালেই পেয়ে যাবেন ইতিহাসের গন্ধ। সেই দোকানেই ঝোলানো রয়েছে কিছু কথা। যেটা কতকটা এইরকম—
“চা পানের উপকারিতা— ইহা খাইতে বেশ সুস্বাদু। ইহাতে কোনও অপকার হয় না। ইহা জীবন উদ্দীপক। ইহাতে মাদকতা শক্তি নাই।”

এটার ঠিক নীচেই লেখা, কী কী অসুখ দূর করতে চায়ের জুড়ি নেই। কিন্তু কেন এইরকম লেখা? এইরকম বিজ্ঞাপনের কি কোনো ইতিহাস আছে?

১৮৯২ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে’র তরফ থেকে রেলপথ পাতা শুরু হল। কুমিল্লা থেকে শুরু করে সেই পথ এগিয়ে গেল তিসুকিয়া, গৌহাটির দিকে। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল চা বাগান। বাগানের শ্রমিক হিসেবে বিহার থেকে লোকজন সেইখানে যেতে লাগল। কিন্তু সেই শ্রমিকদেরকে ক্রীতদাসে পরিণত করতে বেশি সময় লাগল না সাদা সাহেবদের।

একটা সময় প্রতিবাদে গর্জে উঠল শ্রমিকরা। দেশে ফেরার চেষ্টা করতে লাগল তারা। মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে লাগাতার চলছে অসহযোগ। ১৯২১ সালে, গোয়ালন্দ স্টিমার ঘাটে কুলিদের ওপর গুলি চালানো হল। সারা বাংলা জ্বলে উঠল এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায়। চা-মালিকদের ব্যবসায় আঘাত আসতে লাগল। তখনই তাঁদের মাথায় আসে বিজ্ঞাপন বদলানোর চিন্তা। চা-কে বাঙালির সঙ্গে আরও একাত্ম করতে নয়া উপায় বের করলেন তাঁরা। যে উপায়ের একটা নিদর্শন আমরা রোজ দেখতে পাই দমদম স্টেশনে। হ্যাঁ, চা-কে ওষুধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। মানসিক অবসাদ, ম্যালেরিয়া, কলেরার মতো রোগের ‘নিরাময়’ হবে, এমন প্রচার শুরু হল। সেই থেকে এগিয়ে চলেছে দমদম স্টেশনের চা কাউন্টার, এগিয়ে চলেছে চায়ের জয়যাত্রা।