দুই রেল ইঞ্জিনের ডুয়েল লড়াই, ১৩০ বছর আগে অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী ছিল টেক্সাস!

একই রেল লাইনের ওপরে দু’দিক থেকে ছুটে আসছে দুটি ট্রেন (Trains)। অথচ, যেন সেদিকে চালকের ভ্রূক্ষেপ নেই কোনো। ধীর হওয়ার পরিবর্তে ক্রমশ যেন ত্বরান্বিত হয়ে চলেছে তাদের গতি। তার কয়েক মুহূর্ত পরেই ভয়াবহ সংঘর্ষ। বিকট শব্দ তুলে নিজেদের ওপর আছড়ে পড়ল দুই লৌহদানব। 

মুখোমুখি ট্রেন সংঘর্ষে (Head To Head Collision) ঠিক কী ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে, তা নিয়ে আলাদা করে বলার নেই কিছুই। ১৯৯৫-এ কালিন্দী ও পুরষোত্তম এক্সপ্রেসের মুখোমুখি সংঘর্ষে মুহূর্তের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় চার শতাধিক মানুষ। তবে যে ঘটনা দিয়ে এই গল্পের শুরু হয়েছিল, সেটা ছিল সম্পূর্ণভাবে পরিকল্পিত। হ্যাঁ, অবাক লাগলেও এমনটাই সত্যি। রীতিমতো পরিকল্পনা করে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটানো হয়েছিল দুটি আস্ত রেলগাড়ির! সেই গল্পেই আবার ফেরা যাক বরং। 

সেটা ১৮৯৬ সাল। চরম অর্থনৈতিক মন্দা থেকে একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ঠিক এইসময় লাভের খরা কাটাতে অভিনব এক ফন্দী আঁটে মিসৌরি-কানসাস-টেক্সাস রেলরোড, যা স্থানীয়দের কাছে পরিচিত ছিল ‘দ্য ক্যাটি’ নামে। বিপণন এবং যাত্রী সংখ্যা বাড়াতে অভিনব এক প্রচার তথা বিজ্ঞাপনের পরিকল্পনা করে মার্কিন সংস্থাটি। নেপথ্যে ছিলেন ক্যাটির পরিচালক উইলিয়াম জর্জ ক্রাশ। 

সময়টা উনিশ শতকের শেষের দিক। তখন ইউরোপ তো বটেই, যুক্তরাষ্ট্রেও ডুয়েল লড়াইয়ের প্রচলন ছিল বেশ। রেল কোম্পানির প্রচারের জন্য ক্রাশ বেছে নিলেন এই ডুয়েলকেই। তবে মানুষে মানুষে এই যুদ্ধ হবে না। বরং, এবার ডুয়েল লড়বে দুই রেল ইঞ্জিন। সাধারণ মানুষদের জন্য টিকিটেরও ব্যবস্থা থাকবে সেখানে। 

আরও পড়ুন
শীতকালে চালিয়ে রাখা হয় গাড়ির ইঞ্জিন, পৃথিবীর ‘শীতলতম’ শহরের দস্তুর এমনই

যেমন পরিকল্পনা, তেমনই কাজ। ডাক পাঠানো হল আমেরিকার সেরা রেল ইঞ্জিনিয়ারদের। আদৌ দর্শকদের জন্য এই লড়াই কতটা নিরাপদ সেটা তো জেনে নিতে হবে আগে থেকে। দশ জন ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে তৈরি হল একটি বিশেষজ্ঞ দল। প্রায় সকলেই জানালেন, ট্রেন চালু হওয়ার পর চালককে যদি বার করে আনা যায় ট্রেন থেকে তবে বিপত্তির আশঙ্কা নেই। তবে বাধ সাধলেন এক ইঞ্জিনিয়ার। জানালেন, সংঘর্ষে কোনোক্রমে বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের বয়লারে আঘাত লাগলে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। 

আরও পড়ুন
রাজপথ দিয়েই ছুটত রেলগাড়ি! কোথায় হারিয়ে গেল কলকাতার ‘ধাপা মেল’?


আরও পড়ুন
১৭০ বছর আগে, পদ্মার নিচ দিয়ে টেলিগ্রাফের তার পেতেছিলেন বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার

যদিও সে কথায় কর্ণপাত করেনি কেউ-ই। পরিকল্পনা পাকাপাকি হয়ে যাওয়ার পরই ঢালাও প্রচারে নামে ‘দ্য ক্যাটি’ কোম্পানি। পোস্টার পড়ে গোটা টেক্সাস ও মিসৌরি জুড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন খবরের কাগজেও প্রায় রোজই প্রকাশিত হত রোমহর্ষক প্রবন্ধ। ফলে হু-হু করেই বিকোতে থাকে ডুয়েলের টিকিট। কিন্তু কোথায় হবে এই লড়াই? সাধারণ রেলস্টেশনে এমন প্রদর্শনীর আয়োজন যেমন বিপজ্জনক, তেমনই সেখানে বিপুল পরিমাণ দর্শকদের জায়গা দেওয়াও দুষ্কর।

শেষ পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান দিলেন স্বয়ং পরিচালক উইলিয়াম ক্রাশ। টেক্সাসের বুকেই একটি আস্ত শহর তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। নিজের নামেই সেই অস্থায়ী শহরের নাম দিলেন ‘ক্রাশ সিটি’। তিন দিক পাহাড়ে ঘেরা এই শহরে স্থাপিত হল ৫ মাইল দীর্ঘ রেললাইন। গড়ে উঠল রেস্তোরাঁ, ক্যাফে, স্পিকার স্ট্যান্ড, প্রেস ইউন্ডো, টেলিগ্রাম অফিস এমনকি মোটেলও। বাতিল হয়ে যাওয়া দুটি রেলইঞ্জিনকে পুনরায় সারিয়ে রঙের প্রলেপ চাপানো হল তাদের ওপর। পিছনে জুড়ে দেওয়া হল বেশ কয়েকটি মালবাহী ফাঁকা বগিও। তারপর অতিপ্রতিক্ষিত ডুয়েল— ‘দ্য ডুয়েল অফ আয়রন মনস্টার’… 

শুরু থেকে পরিকল্পনামাফিকই হয়েছিল সবটা। দিনটা ছিল ১৫ সেপ্টেম্বর। ক্রাশের অস্থায়ী শহরে হাজির ছিলেন প্রায় ৪০ হাজার দর্শক। দেশ-বিদেশের মিডিয়া, পুলিশ— কম ছিল না কিছুই। হুইসল বাজার সঙ্গে সঙ্গে রেল ট্র্যাকের দু’প্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে নিজেদের দিকে এগোতে থাকল দুই যন্ত্রদানব। ইঞ্জিনের গতি ১৫ মাইল প্রতি ঘণ্টা হওয়ার পরেই চলন্ত গাড়ি থেকে ঝাঁপ দিয়ে বেরিয়ে এলেন দুই চালক। অন্যদিকে ক্রমশ গতি বাড়াতে থাকলে ইঞ্জিন দুটি। এরপর প্রায় ৫০ মাইল প্রতি ঘণ্টা বেগে আছড়ে পড়ল একে অপরের উপর। গোটা শহর তখন ভেসে যাচ্ছে সাধারণ মআনুষের উত্তেজনা, চিৎকারে। কিন্তু তখন কে-ই বা জানত সেই ইঞ্জিনিয়ারের আশঙ্কাই সত্যিই হবে শেষমেশ? 

হ্যাঁ, দুই ট্রেনের সংঘর্ষে বিস্ফোরিত হয়েছিল ইঞ্জিনের বয়লার। সেইসঙ্গে ২০ লক্ষ ফুট-পাউন্ড শক্তির শক-ওয়েভে তীরের বেগে চতুর্দিকে ছিটকে পড়েছিল জ্বলন্ত কয়লা ও বয়লারের ধারালো লোহার টুকরো। ঘটনাস্থলেই দৃষ্টি হারান এক চিত্রসাংবাদিক। আহত হয়েছিলেন বহু বহু মানুষ। তবে এত কিছুর পরেও উত্তেজনায় ভাঁটা পড়েনি এতটুকু। সুভেনির হিসাবে রেলের ভাঙা টুকরো সংগ্রহ করতে গিয়ে দ্বিতীয় দফায় বিপদের সম্মুখীন হন আরও একদল মানুষ। উত্তপ্ত লোহার টুকরো খালি হাতে তুলতে গিয়ে ঝলসে যান অনেকেই। 

এই দুর্ঘটনা থুড়ি পরিকল্পিত ঘটনায় মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল ক্যাটিকে। তবে সার্বিকভাবে টিকিটে লাভ হয়েছিল তার থেকেও বেশি। যদিও আশানুরূপ লাভ না হওয়ায় মাশুল গুনতে হয়েছিল উইলিয়াম ক্রাশকে। তাঁকে রাতারাতি সরিয়ে দেওয়া হয় পরিচালকের পদ থেকে। 

অবশ্য প্রচারের দিক থেকে একশো শতাংশ সফল হয়েছিল ক্যাটির এই ডুয়েল অফ আয়রন মনস্টার ইভেন্ট। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই ঘটনার পর প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছিল তাদের জনপ্রিয়তা। যাত্রীই হোক কিংবা পণ্য পরিবহন— ক্যাটির নামডাক বেড়েছিল বেশ। সেই কথা বিচার করেই বছর তিনেক পর উইলিয়াম ক্রাশকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনে ক্যাটি। আর তাঁর সেই অস্থায়ী শহর? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহু ঘোস্ট টাউনের মতো পরিত্যক্ত অবস্থায় তা পড়ে আছে আজও… 

Powered by Froala Editor