দাওয়ার সামনে উবু হয়ে বসে আছে একটি ছেলে। হাতে কাঠি; মাটি ভিজিয়ে, একমনে খুঁড়ে চলেছে সেই জায়গা। গতকালই মা দুধপিঠে বানিয়েছে। আচ্ছা, যদি এই দুধপিঠে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়, তাহলে আস্ত একটা গাছ গজাবে? মিথ্যে হবে কেন, স্কুলে রাজুই তো বলল এসব! ও কেন মিথ্যে বলবে? ছেলেটা একমনে তাকিয়ে আছে খোঁড়া মাটির দিকে। দুধপিঠে এনে পুঁতে দিয়েছে সে। সত্যিই কি উঠবে ‘দুধপিঠের গাছ’?
রাতদিন এমন স্বপ্ন আঁকড়ে বেড়ে উঠছে ছেলেটি। আর সেই যাত্রাই একদিন দেখেছিলেন পরিচালক উজ্জ্বল বসু। তৈরি করেছিলেন ‘দুধপিঠের গাছ’ সিনেমা। মুক্তি পাওয়ার আগেই সিনেমাটি আলোচনার কেন্দ্রে ছিল। নদিয়ার আড়ংঘাটার গ্রামবাসীদের অর্থসাহায্যে তৈরি হয়েছে সিনেমাটি। উপরন্তু, প্রথমবার কোনো বাংলা ছবির প্রিমিয়ার আয়োজিত হল গ্রামের খোলা মাঠে। সব দিক দিয়েই ব্যতিক্রমী হয়ে শিরোনামে উঠে এসেছিল ‘দুধপিঠের গাছ’। তবে সেটাই এক ও একমাত্র ‘ইউএসপি’ নয়। অন্তত ছবিটি দেখার পর এই কথা বলাই যায়…
তাহলে ‘ইউএসপি’ কী? এককথায় বলতে গেলে, সিনেমাটির গল্প, অভিনয় ও পরিবেশ— সব মিলিয়ে একটা মায়া উঠে এসেছে রুপোলি পর্দায়। হ্যাঁ, মায়া ছাড়া আর কিই বা বলা যায়! ছবিটি শুরুই হচ্ছে ন্যাড়াপোড়া দিয়ে। ফ্রেমের একপাশে দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে আগুন; ঠিক সামনেই কয়েকজন ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে চিৎকার করে বলছে- ‘আজ আমাদের ন্যাড়াপোড়া, কাল আমাদের দোল’। আর ফ্রেমের অন্যদিকে পূর্ণিমার চাঁদ নিজের আলো ছড়িয়ে আছে। এক মুহূর্তে উঠে এল ছোটোবেলার দৃশ্য। মফস্বলে বেড়ে ওঠা বাচ্চাটা এই সেদিনও চোখের সামনে দেখতে পেত এমন দৃশ্য। এক অদ্ভুত পবিত্রতা, এক অদ্ভুত মন কেমন করা গ্রাস করল প্রথম দৃশ্যেই। পরিচালক উজ্জ্বল বসু এবং সম্পাদক অনির্বাণ মাইতি যাত্রার শুরুটা নির্ধারণ করে দিলেন ঠিক দিকেই…
ছবিটির মূল কেন্দ্রে রয়েছে ছোট্ট গৌর (হর্ষিল দাস)। সে কথা বলতে পারে না। তাই দুই দিদি, বাসন্তী ও লক্ষ্মী (দেবাঙ্গনা গণ, রিয়া দাস) আগলে আগলে রাখে তাকে। আর এখান থেকেই ভেসে ওঠে আরও একটি আখ্যান। মাঠনারায়ণপুরের কুয়াশা ভেদ করে ছুটতে থাকে তিন ভাইবোন। ছোট্ট ছোট্ট কারণে মন কষাকষি, আবার পরক্ষণেই হাত ধরাধরি করে ছুটে যাচ্ছে খেজুর রস খেতে। এরই মাঝে ভেসে আসে দুধপিঠের গাছ। গৌরের মুখে এই অদ্ভুত গাছের কথা শুনে প্রথমে কেউই বিশ্বাস করতে চায়নি। কিন্তু গৌর যে কাউকে বোঝাতে পারছে না নিজের কথা। স্বপ্নে দেখছে, তার পোঁতা দুধপিঠে থেকে মস্ত বড়ো গাছ ডানা মেলেছে তাদের উঠোনে। গাছ থেকে ঝুলে আছে দুধে ভেজানো পিঠে; শিশিরের মতো রস লেগে আছে সেখানে। এমনকি দিদাও তো বলল এমন গাছের কথা! কেমন করে মিথ্যে হতে পারে এসব?
তারপর যখন সত্যি সত্যি গাছ বেরোল? মনে পড়বে, যখন ছোটো ছিলাম আমরা, ২৫ ডিসেম্বরের রাতে বালিশের পাশে মোজা রেখে ঘুমোতাম। সান্টা বুড়ো আসবে, আর মনের মতো উপহার দিয়ে যাবে। কখনও কিছুই থাকত না, কখনও এক আধটা লজেন্স বা পাঁচ টাকা দশ টাকা থাকত। তাতেই আনন্দে ভরে উঠত মনটা। ‘দুধপিঠের গাছ’ সেই কথাই মনে করিয়ে দিল আবার। মনে করিয়ে দিল আমাদের কয়েকদিন আগে ফেলে আসা ছোটবেলা। তাই দুধপিঠের গাছটি যখন উঠল, গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে উঠল। আরে! এই তো এসে গেছে গাছ! তাহলে মিথ্যে হবে কী করে?
আরও পড়ুন
‘দুধপিঠের গাছ’-এর প্রভাব, মোবাইলেই সিনেমা বানাচ্ছে আড়ংঘাটার ছেলেমেয়েরা
সিনেমার হাত ধরে চলতে চলতে কখন যে আমরাই গৌর হয়ে উঠি, খেয়াল পড়ে না। যত সময় গড়ায়, মনে হয় এই সিনেমার চরিত্র একটিই— নদিয়ার গ্রামীণ পরিবেশ, সেখানকার মানুষগুলো। গল্প নয়; যেন এক একটা মুহূর্ত বুনে বুনে তৈরি হয়েছে চালচিত্র। গ্রামের লোকেরা কেবল প্রযোজনাই করেননি, নিজেরাই হয়ে উঠেছেন অভিনেতা। আর সেই রেশ ছড়িয়ে থাকল গোটা ছবিতে। ছবি শুরু হয়েছিল ন্যাড়াপোড়া দিয়ে। আর শেষও হল আগুন দিয়ে। এই আগুন দেখা যায় না। নিঃশব্দে আঘাত করে অবচেতনকে। গৌরের মতো ছুটতে ছুটতে আমরাও দাঁড়িয়ে পড়ি স্টেশন চত্বরে। মনে পড়বে, খানিক আগেই গৌর ও তার দিদা বসেছিল এই স্টেশনেই। একদিকে যাত্রার শুরু, স্বপ্নের শুরু; অন্যদিকে একটা স্বপ্নের শেষ।
আরও পড়ুন
মাল্টিপ্লেক্স নয়, গ্রামের মাঠেই প্রিমিয়ার; নতুন ইতিহাসের জন্ম দিচ্ছে ‘দুধপিঠের গাছ’
আর এই শেষটাই এসে করে দেন অনাথবন্ধু ঘোষ। তাঁর গান, তাঁর গলা এই ছবির সঠিক উপসংহার। শেষ দৃশ্যে এসে ধাক্কা লাগে আমাদেরও। হয়ত কান্নাও আসে এক দু-ফোঁটা। এককথায়, আপাদমস্তক একটি সহজ, নিষ্পাপ ছবি ‘দুধপিঠের গাছ’। সেই অর্থে কোনো স্টারকাস্ট নেই, লাইমলাইট নেই; অথচ কি সুন্দর হাওয়া পুরো ছবিটা জুড়ে ছিল। দামিনী বেণী বসু, কৌশিক রায়ের অভিনয় একেবারে সিনেমার পরিবেশের সঙ্গে যথাযথ। আর রয়েছে বাকি গ্রাম। সবাই এখানে অভিনেতা, সবাই এক একটা মুহূর্তের সঙ্গী। আর এই মুহূর্তকেই আবহে বন্দি করে রাখলেন জয় সরকার। ছবির পরিবেশের সঙ্গে একেবারে যোগ্য সঙ্গত। পুরোটাই একটা স্বপ্নের যাত্রা, তার বেড়ে ওঠা, খেলে বেড়ানো। ঠিক যেন ফেলে আসা এক টুকরো ছোটবেলা। এক টুকরো নিষ্পাপ বাতাস…
বেরোতে বেরোতে একটা কথাই মনে হচ্ছিল বারবার— আমরা যারা প্রতিদিন শহুরে পরিবেশে কষ্ট করে নিঃশ্বাস নিচ্ছি, তাঁরা কি এই মায়াকে ধরতে পারব? বুঝতে পারব মাঠনারায়ণপুর, আড়ংঘাটাকে? বুঝতে পারব গৌরকে? উত্তর পাইনি। হয়তো সম্পূর্ণটা কখনই ধরতে পারব না। গাড়ি ধরার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। পুজোয় চারিদিকে হইচই, আলোয় ঝলমল। তারই মধ্যে, সিনেমাহলের উল্টোদিকে বসে আছে একটি ছোট্ট শিশু। মায়ের কোলে বসে একমনে তাকিয়ে আছে সামনের কুকুরটির দিকে। একসময় বাড়িয়ে দিল হাত। হাতের মুঠোয় পাউরুটি; কুকুরটাও চলে এল নির্ভয়ে। গৌররা সব জায়গাতেই ছড়িয়ে আছে বোধহয়, আমার আপনার বাড়ির পাশেই…
আরও পড়ুন
সিনেমার প্রযোজক প্রত্যেকেই; অর্থনৈতিক সংকটেও আশা হারাননি আড়ংঘাটার গ্রামবাসীরা
Powered by Froala Editor