কলকাতা শহরে একটু একটু করে দুপুর নেমেছে। সমস্ত নিয়ম-স্বাস্থ্য বিধি মেনে দর্শকরাও আসতে শুরু করেছেন নন্দনে। উপলক্ষ্য, বাংলা সিনেমা। সেখানেই দেখা গেল এক অদ্ভুত দৃশ্য। দূর দূর থেকে দর্শকরা এসেছেন একটি বিশেষ সিনেমা দেখার জন্য; কিন্তু অনলাইনে টিকিট কাটতে একটু অসুবিধা হচ্ছে। তখনই এগিয়ে আসছেন একজন। দর্শকদের সাহায্য করছেন টিকিট কাটতে; দরকারে নিজেই কেটে দিচ্ছেন। ভদ্রলোক স্বয়ং সেই সিনেমার পরিচালক— উজ্জ্বল বসু। আর সিনেমাটি? ‘দুধপিঠের গাছ’…
ঠিক ২৫ দিন আগে প্রেক্ষাগৃহে যাত্রা শুরু করেছিল সিনেমাটি। একের পর এক বাধা পেরিয়ে বড়ো পর্দার মুখ দেখেছিল ‘দুধপিঠের গাছ’। এমন একটি ছবি, যার পেছনে কোনো ‘বড়ো’ প্রযোজক নেই। রয়েছেন নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রামের কয়েকশো সাধারণ মানুষ। নিজেরাই অর্থসাহায্য করে তৈরি করেছেন ছবিটি। ‘দুধ পিঠের গাছ’ সেই সাধারণ মানুষদেরই গল্প বলে। একটা গ্রাম, তিন ভাইবোন আর কিছু দৃশ্য। ২০২০-র বাংলা সিনেমার জগতে যেন এক মায়াবী হাওয়া…
গ্রামবাসীদের অর্থসাহায্য থেকে শুরু করে আড়ংঘাটার খোলা মাঠে প্রিমিয়ার— প্রথাগত ধারণাগুলো ভাঙতে ভাঙতে এগিয়েছেন পরিচালক উজ্জ্বল বসু। সঙ্গে ছিলেন তাঁর কলাকুশলীরা। বাংলার ইন্ডিপেনডেন্ট সিনেমার জগত নতুন এক রূপ পেল। করোনার সময়ও কলকাতার মাল্টিপ্লেক্সে হাজির হয়েছিল ‘দুধপিঠের গাছ’। যারাই দেখছেন, প্রত্যেকেই মুগ্ধ হয়েছেন। মাঠনারায়ণপুরের পরিবেশের সঙ্গে, গৌরের সঙ্গে এক হয়ে গেছেন। কিন্তু সিনেমাটি বেশিদিন জায়গা পেল সেখানে। এদিকে বাংলা সিনেমার ‘পীঠস্থান’ নন্দনেও ছবিটি জায়গা পায়নি প্রথমে। সব মিলিয়ে যথেষ্ট চিন্তার মুখেই পড়েছিলেন পরিচালক।
সেসব চিন্তা সরিয়ে আজ ২৫ দিনে পা দিল ‘দুধপিঠের গাছ’। বাংলার ইন্ডিপেনডেন্ট একটি সিনেমা, যার ভাষা অন্য, সেরকম স্টারকাস্ট নেই— তাকেই দর্শক গ্রহণ করছেন প্রাণভরে। অন্যান্য প্রেক্ষাগৃহ থেকে সরে গেলেও, ইতিমধ্যে নন্দনে জায়গা পেয়েছে ছবিটি। আর সেখানেই উঠে এসেছে পরিচালক উজ্জ্বল বসু, সম্পাদক অনির্বাণ মাইতি-সহ গোটা টিমের স্পিরিট। অনলাইন মাধ্যমে টিকিট কাটতে অনেকেরই অসুবিধা। তবুও দর্শকদের কথা ভেবে প্রায় প্রতিদিনই নন্দনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকছেন উজ্জ্বলবাবুরা। যারা টিকিট কাটতে পারছেন না, তাঁদেরকে নিজের উদ্যোগে কেটে দিচ্ছেন টিকিট। যাতে মানুষ বঞ্চিত না হয়। ‘দুধপিঠের গাছ’ও যে মানুষের গল্প, তাদের ছোটো ছোটো স্বপ্নের গল্প…
“এত অসুবিধার মধ্যেও দর্শকরা এসে ছবি দেখছেন, এটা ভালো লাগছে। যারা দেখছেন, বেশিরভাগই ফিরে গিয়ে নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। এখন কেবলমাত্র নন্দনেই ছবিটি চলছে। এবং দর্শকরাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন না কোনোদিনই। অনেকে ফিরেও যাচ্ছেন টিকিট কাটতে না পেরে। আমরা যতটা সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টাও করছি”, প্রহরকে বলছিলেন ছবির পরিচালক উজ্জ্বল বসু। একই সুর শোনা গেল সম্পাদক অনির্বাণ মাইতির গলাতেও। “২৫ দিন পূর্তিকে একটা উৎসব হিসেবে মেনে নিই আমরা। তবে ‘দুধপিঠের গাছ’ যেন আরও অনেকদিন চলে, সেটাই আশা। বাকি হলগুলোতেও যদি দেখানো যেত, তাহলে আরও মানুষের কাছে হয়তো পৌঁছনো যেত। তাও দর্শকরা যে আসছেন, তাতে ভীষণ খুশি। আগামী সপ্তাহেও নন্দনে চলবে। দেখা যাক।”
আর আড়ংঘাটা? লোকাল ট্রেন চালু হবার পর ইতিমধ্যেই আড়ংঘাটা থেকে কয়েকজন চলে এসেছেন নন্দনে। বাকিরাও আসবেন, নন্দনে বসে দেখবেন তাঁদের নিজেদের সিনেমা। সেই অপেক্ষাতেই দিন গুনছেন সবাই। ‘দুধ পিঠের গাছ’ আরও অনেকদিন প্রেক্ষাগৃহে থাকুক, দর্শকদের এভাবেই মোহিত করুক সেটাই এখন চাওয়া।
আরও পড়ুন
বাঙালি-সংস্কৃতি আর বাংলার অসহায় মানুষদের মর্মকথা বলে ‘দুধপিঠের গাছ’
Powered by Froala Editor