তখন মধ্যরাত। ঘড়ির কাঁটায় ৩টে বেজে পাঁচ মিনিট। এমন সময় বিকট এক যান্ত্রিক আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল শহরবাসীর। এত রাতে দুর্ঘটনা ঘটল নাকি কোনো? ঘুম চোখেই অনেকে বেরিয়ে এলেন ব্যালকনিতে। আর তারপর তাঁরা যা দেখলেন, তা চমকে ওঠার মতোই। রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে আস্ত এক উড়োজাহাজ। তখনও ইঞ্জিন থেকে ধোঁয়া বেরচ্ছে তার। রাস্তায় উড়োজাহাজ? সত্যিই তো। এ ঘটনা দিবাস্বপ্ন মনে হওয়ারই কথা! তবে বাস্তবেই এমনটা ঘটেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে। কিন্তু শহরের রাস্তায় খোদ এরোপ্লেন অবতরণের কারণ কী?
কথায় আছে না, ‘জাতে মাতাল, তালে ঠিক’। এই ঘটনার পিছনের গল্প একেবারে আক্ষরিক অর্থেই মিলে যায় এই প্রচলিত বাংলা প্রবাদের সঙ্গে। একটু খুলে বলা যাক সেই ঘটনার কথা। সেদিন সেই বিমানের ককপিটে চালকের আসনে ছিলেন টমাস ফিটজপ্যাট্রিক নামের ২৬ বছরের এক ব্যক্তি। পনেরো বছরের গণ্ডি পেরনোর আগেই থমাস যোগ দিয়েছিলেন মার্কিন সেনাবাহিনীতে। সেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। যুদ্ধের ময়দানে এমন লক্ষ লক্ষ কিশোরকে পাঠানো হয়েছিল বন্দুক হাতে। সেভাবেই মেরিন কর্পের সদস্য হয়ে উঠেছিলেন থমাস। তবে বিশ্বযুদ্ধ শেষের পরেও মার্কিন সেনাবাহিনীতে থেকে যান তিনি। আর্মির হয়ে কাজ করেন আরও এক দশক। অংশ নিয়েছিলেন কোরিয়ার যুদ্ধেও।
সেই যুদ্ধে আহত হওয়ার পর সেনাবাহিনী থেকে অবসরগ্রহণ করেন থমাস। তবে যুদ্ধ নিয়ে এতটুকু কমেনি তাঁর ফ্যান্টাসি। শহরে ফেরার পরই নিউ জার্সির এয়ারোনটিক্স স্কুলে বিমান চালানোর প্রশিক্ষণ নেন তিনি। পাশাপাশি পেট চালানোরও ব্যবস্থা করতে হবে। শিখলেন বিমান মেকানিকের কাজ। অসুবিধা হল না চাকরি জোটাতে। নিউ জার্সির সেই বেসরকারি বিমান ট্রেনিং স্কুলেই কাজ মিলল। ছাত্রদের প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ ছোট্ট সিঙ্গেল ইঞ্জিন বিমানগুলির দেখভাল এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হল তাঁর কাঁধে।
দিব্যিই সেই কাজ করে দিন কাটছিল থমাসের। এর মধ্যেই ঘটে গেল এক অদ্ভুত ঘটনা। দিনটা ছিল ৩০ সেপ্টেম্বর। ১৯৫৬ সাল। কাজ সেরে নিউ ইয়র্কের হার্লেম শহরের নিকোলাস স্ট্রিটে এক পানশালায় খানিক আমোদ করতেই গিয়েছিলেন থমাস। সেখানেই এক আগন্তুকের সঙ্গে আলাপ জমে ওঠে তাঁর। কথায় কথায় উঠে আসে কর্মক্ষেত্রের কথাও। লোভ সামলাতে না পেরে বিমান চালানোর প্রশিক্ষণের কথাও বলে বসেন তিনি। কিন্তু উল্টোদিকের মানুষটা বিশ্বাস করলে তবে তো! ততক্ষণে তাঁর মনে বদ্ধ ধারণা জন্মে গেছে এসব থমাসের ভাঁওতা। তিনি কেবলমাত্র একজন সাধারণ মেকানিক। আর পাইলটের যে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখাচ্ছেন থমাস, তাও জালি।
আরও পড়ুন
হারিয়ে-যাওয়া বিমানের সন্ধান দিল ক্যালিফোর্নিয়ার খরা
একজন প্রাক্তন সৈনিকের সঙ্গে এহেন ব্যবহার! ব্যাপারটা আত্মসম্মানে আঘাত করে থমাসের। না, প্রমাণ তাঁকে দিতেই হবে। যেমন ভাবনা, তেমনই কাজ। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ২টো। বার থেকে গাড়ি নিয়েই ফ্লাইং স্কুলের দিকে রওয়ানা দিলেন থমাস। মিনিট কুড়ির পথ। কর্মী হওয়ার সুবাদে গ্যারাজের চাবি থেকে শুরু করে সবকিছুই ছিল তাঁর কাছে। ফলত, ফ্লাইং স্কুল থেকে ছোট্ট সিঙ্গেল ইঞ্জিন উড়োজাহাজটি বার করে আনতে অসুবিধা হল না। তারপর নেশাগ্রস্ত অবস্থাতেই তা চালিয়ে সোজা সেই বারের সামনে এনে হাজির হন থমাস।
আরও পড়ুন
প্রতিবাদী সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করতে বিমান ‘হাইজ্যাক’ বেলারুশের!
যদিও তাঁর পরিকল্পনা ছিল নিকটবর্তী নিকোলাস স্ট্রিট স্কুলের মাঠেই অবতরণ করার। কিন্তু সেখানে ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকায় অবতরণের জন্য রাস্তাকেই বেছে নেন থমাস। তবে কাজটা যে কতটা কঠিন ছিল, তা বলে বোঝানো যাবে না। লম্বা লম্বা বহুতল উঠে গেছে রাস্তার দু’ধারে। ফলত, সামান্য ভুলে ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা তো রয়েছেই। আর চওড়ায় রাস্তার প্রস্থ ডানা মেলা বিমানের থেকে মাত্র ফুট পাঁচেক বেশি। রাস্তায় ধারে পার্কিং স্লটে বড়ো কোনো বাস থাকলেও দুর্ঘটনা ঘটতে বাধ্য। তবে এসব কাটিয়েই নির্ঝঞ্ঝাটভাবে বিমানটিকে নামিয়ে আনেন থমাস।
আরও পড়ুন
খোঁজ মেলেনি কোনোদিন, আকাশেই হারিয়ে যাওয়া প্রথম পাঁচটি বিমানের গল্প
থমাসের সেই কীর্তিতে রীতিমতো হইচই পড়ে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। প্রথম সারির সমস্ত সংবাদপত্রেই ফলাও করে ছাপা হয় এই ঘটনার কথা। আর পুলিশ? এই কাজ আইননিষিদ্ধ হলেও, কার্যত হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। প্রশংসা ঝরে পড়ে তাঁদের মুখেও। এনওয়াইপিডি’র এক সার্জেন্ট সেসময় জানিয়েছিলেন এমন রাস্তায় দক্ষ পাইলটেরও সফল অবতরণের সম্ভাবনা ১ লক্ষ বারের মধ্যে ১ বার। ফলত, তাঁর এই কৃতিত্বেই যেন ঢাকা পড়ে গিয়েছিল দোষ। ১০০ ডলারের জরিমানা দিয়েই মুক্তি পান থমাস। অবশ্য বাতিল হল তাঁর ফ্লাইং লাইসেন্স।
তবে এখানেই শেষ হয়নি থমাস ফিটজপ্যাট্রিকের পাগলামি। বছর দুয়েক পরে আবার হুবহু একই ঘটনা। দিনটা ছিল ১৯৫৮ সালের ৫ অক্টোবর। এবার তার পাগলামির সাক্ষী হল ম্যানহাটন। এবারেও দায়ী সেই মদ্যপানই। আমস্টারডাম স্ট্রিটের একটি বারে পুনরায় এক ব্যক্তি অস্বীকার করেন তাঁর পূর্ববর্তী কৃতিত্বকে। ফলত, প্রমাণ দিতে পুনরায় রাস্তার ওপরে বিমান অবতরণ। তবে এবারে চওড়া রাজপথ হলেও, ভর সন্ধেবেলায় বিমান নিয়ে রাস্তায় নামলেন তিনি। রাজপথ তখন লোকারণ্য। ট্যাক্সি, বাস— এসবও রয়েছে বেশ ভালোমতোই। আকাশ থেকে বিমান নেমে আসতে দেখে দ্রুত রাস্তার দু’ধারে সরে গেলেন সকলেই। তবে টাল সামলাতে পারলেন না এক বাইকযাত্রী। প্রাণহানি না ঘটলেও, ঘটে গেল ছোটখাটো একটি দুর্ঘটনা। সংঘর্ষ লাগতে পারত একটি বাসের সঙ্গেও। তবে অল্পের জন্য রক্ষা পান থমাস।
ঘটনার পরে নিজেই পুলিশের কাছে গিয়ে দ্বারস্থ হন তিনি। মদ্যপ অবস্থায় রাগ সামলাতে না পেরেই যে এই ঘটনা, তাও স্বীকার করে নেন থমাস। তবে এবার বেশ কড়াভাবেই বিষয়টি দেখে মার্কিন প্রশাসন। বিমান চুরি, অনৈতিক অবতরণ, ফ্লাইন লাইসেন্স না থাকা-সহ একাধিক বিষয়ে মামলার রুজু করা হয় তাঁর নামে। বড়ো অঙ্কের জরিমানার পাশাপাশি খাটতে হয় ৬ মাসের জেলও। আর তারপরেই মতি ফেরে থমাসের। খামখেয়ালিপনার অবসান করতে নিজেই এরোপ্লেন মেকানিকের কাজ ছাড়েন তিনি। নিজের জীবনের পরবর্তী ৫১ বছর স্টিমফিটার হয়েই কাজ করেছেন তিনি বিভিন্ন আবাসনে। ২০০৯ সালে ৭৯ বছর বয়সে নিউ ইয়র্কে মৃত্যু হয় তাঁর। তবে আজও রূপকথা হয়েই অমর রয়ে গেছে তাঁর কীর্তিকলাপ। এমনকি তাঁর নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বারেই প্রচলিত রয়েছে এক বিশেষ অ্যালকোহলিক ড্রিঙ্ক। নাম ‘লেট নাইট ফ্লাইট’। তবে গোটা বিশ্বের ইতিহাসেই এমন সংকীর্ণ রাস্তায় বিমান অবতরণের সাহস দেখাননি দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি!
Powered by Froala Editor