হোয়াটস্ অ্যাপে স্টাডি মেটিরিয়াল পাঠিয়েছিলেন শিক্ষক। ছাত্র-ছাত্রীরা সকলে মিলে ভাগ করে নেবে, এমনটাই ভেবেছিলেন। গোলমাল অন্যত্র। গ্রুপের যে-ছাত্রীর স্মার্টফোন নেই, সে যখন পড়শি ছাত্রীর কাছে নোট দেখতে চাইল, এককথায় প্রস্তাব খারিজ হল। কেন? না, স্যার তো বলেননি আর-কাউকে দেখাতে। বাধ্য হয়ে, ওই ছাত্রী আরও অনেকের কাছে চাইতে-চাইতে শেষে একজন ‘বন্ধু’ পায়, যে তাকে নোটস দেখায়; সে খাতায় লিখে নেয়। অথচ এতদিন গ্রুপের বাকিদেরও সে ‘বন্ধু’ই ভাবত।
আনলক পর্যায়ের এই ঘটনা ছাত্রীটির মুখেই শুনতে-শুনতে মনে হচ্ছিল, এ কি নেহাতই সাধারণ ঘটনা? অল্পবয়সিদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হিসেবে সামান্যীকরণ করলে হয়তো স্বস্তি মিলবে। তাতে সমস্যা বদলাবে না। বিষয়টিকে দুভাবে ভাবা যেতে পারে। এক, এমনটা ভাবার কারণ নেই যে, নোট দেখানো বা না-দেখানো নিয়ে আগে এই ধরনের প্রতিযোগিতা হত না। ফলে এটা নতুন কিছু নয়। বিদ্যালয়ের পরিসর এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠত। উদারতার যে-পাঠ সেখানে মিলত, তাতে এই প্রবৃত্তি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকত। যদিও, এখানে বলা যায়, পরীক্ষাব্যবস্থা স্বয়ং পড়ুয়াদের এক বিষম প্রতিযোগিতার মুখেই ঠেলে দেয়। এমনকি সিলেবাসও সে-দোষে অনেকাংশে অভিযুক্ত। তা সত্ত্বেও পড়ুয়াদের মানসিক প্রসারতার দিকে নজর দেওয়া সম্ভব হত বিদ্যালয়ে। এখন আর সে-সুযোগ নেই। সহাবস্থানের শিক্ষা নেই অনলাইনের সিলেবাসে। পুরোটাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক।
দুই, যে-কারণে দ্বিতীয় ছাত্রীটি নোট দেখাতে রাজি হল না, তা শুধু এই যে, তার একটি স্মার্টফোন আছে। সেটি সে কেনেনি। তবু বস্তুটি থাকার দরুণ নতুন ব্যবস্থায় যে-ক্ষমতাবোধ জন্মে, পুরোমাত্রায় তা প্রয়োগ করেছে সে। তার অল্পবয়সি মন এই বিভেদ বা ক্ষমতাপ্রয়োগের মোহ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারেনি। মূল সমস্যা ও ভয়ের কারণ এটাই।
বিদ্যাদানের জন্য নির্দিষ্ট পরিসরটি ঠিক এই কারণেই গুরত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যদিও পরিস্থিতির হালচাল দেখে অনেকেই ভাবছেন, এবার থেকে কি অনলাইন পঠনপাঠনই স্বাভাবিক বলে ধরে নিতে হবে? বিষয়টি নিয়ে ভাবিত শিক্ষক-শিক্ষিকারাও। আপাতত অনলাইনেই ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেও, শিক্ষক শতাব্দী দাস বলছেন, “অনলাইন ক্লাসের সুযোগ সকলে যে পাচ্ছে না, তা তো সত্যি। তা ছাড়াও, শিক্ষা বলতে তো কেবল সিলেবাস শেষ করা নয়। স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের যে সার্বিক শিক্ষাদানের সুযোগ থাকে, নীতি-নৈতিকতা সংক্রান্ত বিষয়গুলো একজন শিক্ষক যেভাবে শেখাতে পারেন, টেক্সটের সঙ্গে জীবনকে সংযুক্ত করে যেভাবে দেখাতে পারেন, তার সুযোগ অনলাইন ক্লাসে কোথায়!” বস্তুত, অনলাই ক্লাস আদপে যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তা মূলত তথ্যের আদানপ্রদান। কিন্তু সেটুকুই তো সব নয়। “আমরা তো শুধু তথ্যটুকু জানাই না। তথ্য নিশ্চয়ই গুরত্বপূর্ণ, কিন্তু সবথেকে জরুরি তার বিশ্লেষণ। ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে আই-কনট্যাক্ট না-হলে তা সম্ভব নয়।,” মত অধ্যাপক বিশ্বজিৎ পাণ্ডার। পাশপাশি, তিনি জানাচ্ছেন, উচ্চশিক্ষায় যে সমস্ত গবেষণা ক্ষেত্রসমীক্ষার উপর নির্ভর করে, তাও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিক্ষক-ছাত্র দুজনেই এক্ষেত্রে অসহায়।
কথায়-কথায় উঠে আসছে কিছু পদ্ধতিগত সমস্যাও। অনলাইনে যেভাবে ক্লাস হচ্ছে, তাতে দুটো সমস্যা বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। ধরা যাক, দুজন শিক্ষক পরপর ক্লাস করালেন। পর্যাপ্ত মোবাইল ডেটা না-থাকলে একজন পড়ুয়া টানা ক্লাস করতে পারবে না। অন্যদিকে চালু কিছু অ্যাপের মাধ্যমে ক্লাস করাতে গিয়ে শিক্ষকরাও সমস্যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পড়ুয়াদের ভিডিও অফ থাকছে; ফলে মুখ দেখে যে জানা যাবে, কারও বুঝতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি-না, তার উপায় নেই। এমনকি, একজন পড়ুয়া আদৌ শিক্ষকের কথা শুনছে কি-না, তাও বোঝা যাচ্ছে না।
এ তো গেল স্মার্টফোন থেকেও যা যা সমস্যা। আরও গুরুতর সমস্যা ফোন না-থাকা বা পড়ুয়াদের হাতে তা না-দেওয়া। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই আর-এক স্কুলশিক্ষক পৌলমী চক্রবর্তী বলছেন, “বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীর সুযোগই নেই যে, অনলাইন ক্লাস করবে। গ্রাম-মফস্সলের স্কুলের দিকে তাকালেই দেখা যাবে, অনেকেই হয়তো ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার। তাদের বাড়িতেও ফোন নেই। ফলে এই পড়ুয়ারা কীভাবে ক্লাস করবে তার নিশ্চয়তা নেই। স্কুল খুললেও অভিভাবকরা তাদের পাঠাবে কি-না, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা। এদিকে শিক্ষাবর্ষ নষ্ট হোক, তা কেউ-ই চাইছেন না। এমনিতেও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত রিটেনশন নেই। সেদিক থেকে সমস্যা না-হলেও, এই পরিস্থিতিতে বা এর পরবর্তীতে পড়ানো যে কেমন হবে, পড়ুয়াদের সঙ্গে শিক্ষকের যোগাযোগ ও সম্পর্ক কীভাবে রাখা সম্ভব হবে, তা বেশ চিন্তাভাবনারই বিষয়।” সত্যি বলতে এই সমস্যা সমাধানের জন্য খুব যে পরিকল্পনা করা হচ্ছে তাও নয়। উলটে, শিক্ষকরা বসে বসে বেতন নিচ্ছেন, সমাজের এক শ্রেণির মানুষের এহেন অভিযোগ সরাসরি প্রভাব ফেলছে পড়ুয়াদের মনে। সামাগ্রিক অবিশ্বাসের দূষণ যেন এই মধুরতম সম্পর্কের শ্বাসরোধই করেছে বলা যায়।
আরও পড়ুন
বিশ্বভারতী এবং একটি পাঁচিল: রবীন্দ্রনাথের শিক্ষারীতির ভিতটাই দুর্বল হয়ে পড়ছে কি?
স্মার্টফোন সহজলভ্য করে তোলার জন্য স্থানিক স্তরে কিছু চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে। কোনও কোনও স্কুল উদ্যোগ নিয়ে আবেদন জানাতে চাইছে যে, পুরনো বাড়তি হ্যান্ডসেট নাগরিকরা যদি পড়ুয়াদের দিয়ে দেন, তাহলে খানিকটা হলেও তাদের সুরাহা হয়। তার জন্য একটি যোগাযোগ কেন্দ্রও গড়ে তোলা হচ্ছে। অর্থাৎ, যেখানে পুরনো সেট জমা দেওয়া যাবে। সেখান থেকে স্বেচ্ছাসেবকরা প্রয়োজনমতো তা পড়ুয়াদের কাছে পৌঁছে দেবেন। সাধু উদ্যোগ। তবে রাজ্য বা কেন্দ্রস্তর থেকে এ-ব্যবস্থা গৃহীত হলে হয়তো আরও ভালো ফল মিলবে।
এতদসত্ত্বেও, যে-প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে তা হল, বিদ্যালয়ের ধারণা মুছে যাওয়াই কি তবে ‘নিউ নর্ম্যাল’? স্কুল খোলা নিয়ে ইতিউতি কথাবার্তা উঠলেও, অভিভাবকরা সঙ্গত কারণেই সাহস পাচ্ছেন না। ফলে, না-পাঠানোর মতেই পাল্লা ভারী। শিক্ষকরাও পড়ুয়াদের সঙ্গে যোগাযোগের আর-কোনও উপায় পাচ্ছেন না, ফলে অনলাইন-ই দস্তুর। কিন্তু, তা যতটা গোছালো হওয়া উচিত ছিল, তা কিছুতেই হচ্ছে না। দূরত্ব ও নিঃসঙ্গতা যেন থেকেই যাচ্ছে। পঠনপাঠন প্রক্রিয়াটি কেবল পড়ুয়াদের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানোয় সমীকৃত হয়ে উঠছে, যা মেনে নিতে পারছেন না শিক্ষকরাও।
সিলেবাস শেষ ও পরীক্ষা যদি একমাত্র গুরুত্ববাহী হত, তাহলে বিদ্যালয়ের পরিসরের কোনও দরকারই কোনোদিন হত না। আশ্রমিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই পাঠদানের জায়গাটিকে বরাবর আলাদা করা হয়েছে। পড়াশোনার পাশাপাশি, তা পড়ুয়াদের জীবনবোধেরও শিক্ষা দেয়। সব যে হাতে পুথি ধরিয়ে তা নয়, কিন্তু এই ব্যবস্থার ভিতরেই সেই জিনিসগুলি রাখা, যা একজন অল্পবয়সির মনকে এই সমাজের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলে। জীবনের যা-কিছু পালনীয় ধর্ম, সে সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল করে তোলার হাতেখড়ি এখানেই। পরবর্তী জীবনে কে তা কতটুকু পালন করছে, তা আলাদা কথা। কিন্তু জীবনের সহজপাঠের সূচনাটি করা যেত বলেই বিদ্যালয় নামক ধারণাটি আমাদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ । হালের ‘নিউ নর্ম্যাল’ এসে ক্রমশ যেন সেই ধারণার স্লেটে তুলি বুলিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছে সবটুকু। ফলে, যে-নোট এমনিই একাদশ শ্রেণির ছাত্রীটি পেয়ে যেত, একজন না-দেখালেও পাশের বেঞ্চের অপরজন যা দেখিয়ে দিত, তাই-ই ক্রমশ জন্ম দিচ্ছে এক ধরনের অপ্রতিবিধেয় ক্ষমতাতন্ত্রের। বিভাজনের নতুন অসুখ এখন নেমে আসছে মহামারীর সিড়ি ধরে।
আরও পড়ুন
মুক্তিযোদ্ধা থেকে শিক্ষাব্রতী – বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে ‘বাচ্চু ভাই’ ছিলেন নিরলস
Powered by Froala Editor