পঞ্চাশ-ষাটের দশক। বাংলার স্বর্ণযুগের সময়। প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রেই ভারতে ছড়িয়ে পড়ছেন বাঙালিরা। শিক্ষাক্ষেত্রে তো বটেই। সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহা, প্রশান্ত মহলানবিশ— আরও কত নাম উঠে এসেছিল সেই সময়। এমন স্বর্ণযুগে মেয়েরা কোথায় ছিল? তখনও কি যুগের হাওয়া তাঁদের কাছে পৌঁছয়নি? না, তা একেবারেই নয়। পদার্থবিদ্যার মতো তখনও অবধি ‘পুরুষপ্রধান’ বিজ্ঞানের শাখায়, নিজের মেধা দিয়ে, দক্ষতা দিয়ে পা রেখেছিলেন এক বাঙালি নারী। অর্জন করে নিয়েছিলেন পদার্থবিদ্যায় বাংলার প্রথম মহিলা ডক্টরেটের শিরোপা। তিনি, পদার্থবিদ ডঃ পূর্ণিমা সিনহা।
তখনকার দিনে মেয়েরা যেরকম রক্ষণশীল পরিবারে বড় হত, পূর্ণিমা সেই পরিবেশ পায়নি। ১৯২৭ সালের ১২ অক্টোবর, কলকাতায় জন্ম হয় তাঁর। বাবা ছিলেন সেই সময়ের একজন বড় আইনজীবী এবং লেখক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। ছোট থেকেই বাড়িতে ছিল আধুনিকতার হাওয়া। ছিল মানুষকে মানুষ মনে করার শিক্ষা। তাই ছেলে আর মেয়ের মধ্যে কখনই আলাদা করে কিছু মনে হয়নি তাঁদের। সেইভাবেই বেড়ে উঠেছেন পূর্ণিমারা। বাড়ির বাকি মেয়েরা যখন অঙ্ক, রসায়নের দিকে গেল, তখন পদার্থবিদ্যার দিকে আকৃষ্ট হলেন পূর্ণিমা। সেই আকর্ষণ ভালবাসার থেকেই।
আশুতোষ কলেজ, স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে পূর্ণিমার পাড়ি দেওয়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সালটা ১৯৫১। সেই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের খয়রা অধ্যাপক হিসেবে ছিলেন পদার্থবিদ ও বিজ্ঞানী ডঃ সত্যেন্দ্রনাথ বসু। পদার্থবিদ্যার প্রতি পূর্ণিমার ভালবাসা, নিষ্ঠা এবং মেধা দেখে মুগ্ধ হলেন তিনি। জহর চিনতে ভুল করলেন না কিংবদন্তি এই বিজ্ঞানী। সেই বছরেই তাঁর রিসার্চ টিমের সঙ্গে যুক্ত করে নিলেন পূর্ণিমাকে। ১৯৫৫ সালে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই গবেষণা সম্পূর্ণ করেন তিনি। বিষয় ছিল ‘X-ray & differential thermal analysis of Indian clays’। এর জন্য নিজেই নিজের যন্ত্রপাতি তৈরি করেছিলেন পূর্ণিমা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত বাতিল যন্ত্রাংশ নিয়ে তৈরি করেছিলেন নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস। আর সেটা দিয়েই সম্পূর্ণ হয় তাঁর পরীক্ষা। আর এটাই তাঁকে এনে দিল ডক্টরেট। পদার্থবিদ্যায় বাংলার প্রথম মহিলা ডক্টরেট। মনে রাখবেন, সালটা ১৯৫৬।
এরই মধ্যে সুরজিৎ চন্দ্র সিনহার সঙ্গে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন তিনি। সুরজিৎবাবু পরবর্তীকালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য হয়েছিলেন। পূর্ণিমা শুধু পদার্থবিদ্যাতেই নন, অন্য নানা বিষয় কৃতকর্ম ছিলেন। আঁকা, গান, তবলা, ভাস্কর্য, লেখা— সবেতেই মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তিনি। বাঙালি নারীদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিলেন ডঃ পূর্ণিমা সিনহা।