ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, ৯৩ বছরে প্রয়াত হলেন সাহিত্যিক ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী

তখন দেশভাগ হয়ে গেছে। দুই বাংলাতেই চলছে হাহাকার, মৃত্যুমিছিল। অভাবের তাড়নায় প্রতিদিন জ্বলছে শত শত পরিবার। তেমনই একটি পরিবারের কর্তা হলেন একজন শিক্ষক। সবাইকে জ্ঞান বিতরণ করে এসেছেন এতদিন, কত কৃতি ছাত্র তাঁর হাত ধরে বড়ো হয়েছে। কিন্তু সংসারটা? সেখানে তো প্রতিমুহূর্তে দারিদ্র্য। অনেক চেষ্টা করছেন বাঁচার, কিন্তু পারলেন না আর। পরিবারের সবাইকে নিয়ে আত্মহত্যা করলেন তিনি। কোথাও কেউ বিছলিত হলেন না এই ঘটনায়, একজন ছাড়া। তাঁকে নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল এমন ভয়ংকর পরিস্থিতি। হাতে উঠে এল কলম। লিখে ফেললেন একটি কবিতা, ‘তালেব মাস্টার’। সেই ঝড়ের মধ্যে দিয়েই জন্ম হল সাহিত্যিক ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী। বাংলাদেশের অন্যতম প্রথিতযশা এই সাহিত্যিক বৃহস্পতিবার প্রয়াত হলেন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর।

আরও পড়ুন
ঘুমিয়ে আছেন নজরুল, ঢাকায় তাঁর সমাধি যেন এক নিরুচ্চার শোকগাথা

নিজের জীবনকালে নানা সময় নানা ভূমিকা পালন করেছেন। টাঙ্গাইলের এই সন্তান তরুণ বয়সে চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও। আঞ্চলিক বাংলা ধাঁধা সংগ্রহ করে তাঁকে পাঠিয়েছিলেন। রবি ঠাকুরও মুগ্ধ হন এই তরুণের কাজ দেখে। সেই টানেই একসময় শান্তিনিকেতন চলে যাওয়া। সেখানেই পড়াশোনা চালিয়ে যেতেন, যদি না দেশভাগের মতো ঘটনা না ঘটত। নিজের ছাত্রজীবনে যথেষ্ট মেধাবী ছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে ছিল অনুসন্ধিৎসু একটি মন, যা লোকসাহিত্যের গবেষণায় তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল বহুদূর। নানা সময় নানা কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। শেষে অধ্যক্ষ হিসেবে জগন্নাথ কলেজে যোগ দেন।

আরও পড়ুন
চিত্রশিল্পীর স্মরণে মেলা, ব্যতিক্রমী উদ্যোগ বাংলাদেশের গ্রামে

শুধু বাংলাতেই নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় ‘ফোকলোর’ বা লোকসাহিত্য গবেষণায় অন্যতম নাম আশরাফ সিদ্দিকী। অবশ্য এতেই থেমে থাকেননি। কবিতা দিয়েই তাঁর লেখক জীবনের সূচনা। ‘তালেব মাস্টার’ বাংলার পাঠককুল আপন করে নিয়েছিল একবারেই। গল্পকার হিসেবে প্রথম প্রকাশ ‘রাবেয়া আপা’। তারপরই লেখেন তাঁর অন্যতম বিখ্যাত বই ‘গলির ধারের ছেলেটি’। এই বইটিই অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায় তাঁকে। এই গল্প অবলম্বনে বহু ছবিও নির্মিত হয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখ্য পরিচালক সুভাষ দত্তের ‘ডুমুরের ফুল’; যা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পায়।

আরও পড়ুন
১২ বছর বয়সে ক্যামেরায় হাতেখড়ি; বাংলাদেশের প্রথম নারী ফটোগ্রাফার তিনি

জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিনি যুক্ত ছিলেন বাংলা একাডেমির সঙ্গে। ১৯৭৬ সাল থেকে টানা ছয় বছর তিনি একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বও পালন করেন। একটা সময় বাংলাদেশ ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ারের প্রধান সম্পাদক ছিলেন আশরাফ সিদ্দিকী। একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ইউনেস্কো পুরস্কার-সহ নানা সম্মানও পেয়েছেন। অবশেষে মৃত্যু তাঁর যাত্রায় দাঁড়ি টানল। ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে বয়সজনিত অসুস্থতা নিয়েই ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। রেখে গেলেন তাঁর বিস্তর কাজ, গবেষণাকে। সঙ্গে থাকল তালেব মাস্টারও।