অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান। সারা বিশ্বের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকা করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন অবশেষে তৈরি হয়ে গেছে বলে দাবি করল রাশিয়া। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা করেছেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোকে পিছনে ফেলে করোনা ভাইরাসের টিকা তৈরিতে প্রথম তাঁরই দেশ। শুধু তাই নয়, ভ্যাকসিনের ঘোষণার পর প্রথম টিকাটি নিয়েছেন প্রেসিডেন্টের কন্যাই।
এর আগে করোনা ভাইরাসের মোকাবিলা করতে প্রতিষেধক টিকা তৈরির পথে হাঁটা শুরু করেছিল অনেক দেশই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে জানানো হয়েছিল, কমপক্ষে ১৫০টি ভ্যাকসিন তৈরির ওপরে চলছে কাজ। ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানির মতো দেশ লাগাতার ভ্যাকসিন আবিষ্কারের প্রচেষ্টায় কোনও খামতি রাখেনি বলে বারবারই জানানো হয়েছে স্বাস্থ্যকর্তাদের তরফে। ব্রিটেনেও দু’টি ভ্যাকসিন তৈরির উপরে লাগাতার চলছিল কাজ। এরমধ্যে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি ভ্যাকসিনটিই সবার আগে আশার আলো দেখাবে বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে রুশ বিজ্ঞানীরাই জিতে নিলেন এই দৌড়।
রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন দাবি করেছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত সমস্ত মাপকাঠিতেই সাফল্যের সঙ্গে উতরেছে এই ভ্যাকসিনটি। করোনা ভাইরাসের মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে এই ভ্যাকসিন, আশা বিজ্ঞানীদের। রুশ প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরেই ভ্যাকসিনটি প্রকাশ্যে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁর সরকার। এমনকি নিজের মেয়ের শরীরেই প্রথম এই ভ্যাকসিনটি প্রয়োগের মাধ্যমে এর ঝুঁকিহীনতার বার্তাই হয়তো দিতে চেয়েছেন রুশ রাষ্ট্রপতি। ভ্যাকসিনের বিপুল চাহিদার কথা মাথায় রেখে, চলতি বছরেই প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষের জন্য ভ্যাকসিন তৈরি লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে চলেছে রাশিয়া, জানানো হয়েছে তাও।
সারা বিশ্বের আশা-ভরসার কেন্দ্রবিন্দু তাই এখন ‘স্পুটনিক ভি’ নামের এই নয়া ভ্যাকসিনিটিকে ঘিরে আবর্তিত হলেও, বিতর্কও তৈরি হয়েছে এর সুরক্ষা সংক্রান্ত প্রশ্নে। মানব কল্যাণ নাকি ব্যবসা, উঠেছে সেই চিরাচরিত প্রশ্নও। রাশিয়ার গামালেয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট অফ এপিডেমিওলজি অ্যান্ড মাইক্রোবায়োলজি এবং রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের যৌথ প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছে এই ভ্যাকসিনটি। রুশ সংবাদ সংস্থায় দাবি করা হয়েছে, গত ১৮ই জুন ৩৮ জনের উপরে এই ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয়েছিল। তাদের সকলের মধ্যেই করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ করার ক্ষমতা জন্মেছে বলেই দাবি রুশ বিজ্ঞানীদের। যদিও এখানেই দেখা দিয়েছে খটকা। এই ভ্যাকসিন তৈরির গবেষণায় আর্থিক সাহায্য করছিল যে সংস্থা, সেই রাশিয়ান ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড বা আরডিআইএফ-এর প্রধান কিরিল দিমিত্রভ জানিয়েছেন ১২ই আগস্ট থেকে এই ভ্যাকসিনটির ফেজ-থ্রি বা তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শুরু হবে।
আরও পড়ুন
করোনা যুদ্ধে সামিল বিল গেটস, ১৫ কোটি ডলার অনুদান ভারতীয় সংস্থা সিরামকে
তাই তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শুরু হওয়ার আগেই কীভাবে এই ভ্যাকসিনটিকে মান্যতা দিয়ে দেওয়া হল, প্রশ্ন উঠছে সেখানেই। আমেরিকার তরফে এই যুক্তিতেই দাবি করা হয়েছে, যেখানে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালই এখনও শেষ হয়নি, সেখানে রাজনৈতিক এবং প্রচারমূলক উদ্দেশ্যেই সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে নিজেদের প্রথম প্রমাণ করতে চাইছে রাশিয়া। এক্ষেত্রে সারা বিশ্বের বিশাল ওষুধের বাজার ধরে ব্যবসায়িক সাফল্য লাভই কি তাহলে একমাত্র উদ্দেশ্য রাশিয়ার, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও।
এর আগে রাশিয়া যখন বারবারই দাবি করে আসছিল যে, তারাই প্রথম করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে আসতে চলেছে, তখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফেও রাশিয়াকে বারবার টিকা তৈরির সমস্ত ধাপ এবং পদ্ধতি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে মেনে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সেই নির্দেশিকাও মানা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যমে। যদিও সেই অভিযোগকে নস্যাৎ করেছে রাশিয়া।
আরও পড়ুন
করোনায় আক্রান্ত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, রয়েছেন আইসোলেশনে
তাই করোনা ভাইরাসকে হারাতে গেলে এই মুহূর্তে ভ্যাকসিনের কোনও বিকল্প নেই, এই সত্য মেনে নিয়েও সারা বিশ্বের গবেষক এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন যে তাড়াহুড়ো করে যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে ভাইরাস নিয়ে চলে এলে তাতে ফল হতে পারে বরং উল্টো। তাই তড়িঘড়ি করে নয় বরং সমস্ত সুরক্ষা নিয়েই বিশ্ববাসীর জন্য উপলব্ধ হোক ভ্যাকসিন, অভিমত বিজ্ঞানীদের। সে ক্ষেত্রে দু’পা পিছিয়ে যাওয়া কখনোই যুদ্ধে হেরে যাওয়া নয়; বরং সময় নিয়ে রণকৌশল তৈরি করে যুদ্ধে জয় লাভের সমস্ত পরিকল্পনা নিয়েই মাঠে নামা ভালো— মনে করিয়ে দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
Powered by Froala Editor