২০০৭ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছিল ঋতুপর্ণ ঘোষের দোসর। কানে তাঁর সেই প্রথম ছবি। ভারতীয় সিনেমার প্রদর্শনী শুরুর দিন ১৯ মে। দুদিন আগেই তাঁর মায়ের মৃত্যুদিন। ঠিক এক বছর আগে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। অন্য সময় বিদেশ যাওয়ার কথা উঠলে লাগেজ গোছানোর সময় সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেন মা। সব খুঁটিনাটি গুছিয়ে দিতেন। কিন্তু এবারে তিনি নেই। তাই সবটাই কেমন এলোমেলো। ১৬ তারিখ রিজার্ভেশন এবং ভিসা সংক্রান্ত সমস্যা মিটল। বাবার কাছে গিয়ে বললেন “বাবা, কান-এ দোসর দেখাবে।” সেই ভাবলেশহীন মুখের আড়ালে যে আনন্দের রেখা ঝলমল করে উঠেছিল, সেটা নিশ্চিত চিনতেন ঋতুপর্ণ।
১৭ তারিখ সকালে গোছগাছ চলছে। বাবা এসে বললেন, “গরম জামা নিয়েছ?” অন্য সময় এই কথাটা মনে করিয়ে দিতেন তাঁর মা। মায়ের অবর্তমানে বাবা সেই দায়িত্ব পালন করলেন। শুধু ঋতুপর্ণকে বোঝাতে হল, কানে ঠান্ডা নেই। সবাই শুধু ট-শার্ট পরেই ঘুরে বেড়ান মে মাসে। তবে বাঙালির কাছে তো বিদেশ মানেই ঠান্ডার দেশ।
লাগেজ যেমন নেওয়ার কথা ছিল, তেমনটা হল না। একটি স্যুটকেস নামিয়ে নিতে হল। ওজন অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে। তার পরেও দেখা গেল লাগেজের ওজন ৫২ কেজি। অর্থাৎ বেশি ভাড়া দিতে হবে। আর হিসাব করে দেখা গেল তার পরিমাণটা ১০ হাজারের থেকে বেশি। ঋতুপর্ণ এবং প্রসেনজিৎ দুজনের মুখই শুকিয়ে গেল। কিন্তু সিনেমার প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে না গেলেই নয়। শেষ পর্যন্ত কাউন্টারের যুবকটি ঋতুপর্ণর নাম শুনেছিলেন বলেই বেশ খানিকটা ছাড় পাওয়া গেল। ভাগ্যিস একটা হিন্দি ছবি করেছিলেন, ভেবেছিলেন পরিচালক। নাহলে দিল্লি এয়ারপোর্টে এমন সুবিধা কি তিনি পেতেন?
তবে শেষ পর্যন্ত এই সুবিধা যে ব্যুমেরাং হয়ে যাবে তা কি তখন ভেবেছিলেন ঋতুপর্ণ? ঢাউস দুটো ব্যাগ নিয়ে কানের হোটেল পর্যন্ত পৌঁছতেই গলদঘর্ম দুজনে। হোটেলে পোর্টার সার্ভিসও নেই। অতএব নিজেদেরই সব নিয়ে যেতে হবে। এইসব যখন ভাবছেন তখনই স্পষ্ট বাংলায় কানে এল, “কী রে ঋতু?” না, ভুল নয়। পিছনে এসে দাঁড়ালেন সঙ্গীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্র। ২১ তারিখ তিনি কান থেকে রওয়ানা হবেন কলকাতায়। তাঁর নিজের বেশি লাগেজ ছিল না। অতএব ঠিক হল একটি স্যুটকেস নিয়ে যাবেন দেবজ্যোতি মিশ্র। যাক, ফেরার সময়ের বোঝা একটু কমল।
আরও পড়ুন
'দরদ' শব্দটির জ্যান্ত মানুষরূপ মনে হয় ঋতুকে
হোটেলে ঘর গুছিয়ে নেওয়ার পর প্রসেনজিতের কাছে গিয়ে ঋতুপর্ণ বললেন, “ক্যামেরাটা বের কর তো। একটা ছবি তুলি।” কলকাতায় এক সহকর্মী ডিজিট্যাল ক্যামেরায় ছবি তোলার সব নিয়ম বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কাজের সময় দেখা গেল সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ও এব্যাপারে তেমন পটু নন। কোনোরকমে ছবি একটা উঠল। তবে তাতে ঋতুপর্ণর চেহারাটা যেন একটা ছায়ামূর্তি।
কান চলচ্চিত্রের আসরেই প্রথম দেখা পরিচালক মণিরত্নমের সঙ্গে। এর আগে ‘চোখের বালি’ করার সময় ঐশ্বর্যের কাছে তাঁর কথা শুনেছিলেন। শুনেছিলেন, সত্যজিতের সিনেমার সঙ্গে ঐশ্বর্য রাইয়ের পরিচয় মণিরত্নমের হাত ধরেই। অভিষেক বচ্চন, অজয় দেবগন, মনীষা কৈরালা, প্রীতি জিন্টা – প্রত্যেকেই অভিনয় করেছেন দুই পরিচালকের ছবিতেই। দেশবিদেশের অসংখ্য চিত্রনির্মাতার ভিড়ে সেই একজন সঙ্গী খুঁজে পেয়েছিলেন ঋতুপর্ণ।
আরও পড়ুন
এই ছবি করার পর 'পার্সেল' এলে ভয়ও পেতে পারি: ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত
এর মধ্যেই প্রদর্শিত হল দোসর। দর্শকদের কি ভালো লাগল সিনেমা? বোঝার উপায় নেই। প্রত্যেকের মুখই যেন ভাবলেশহীন। ঠিক তাঁর ‘বাবার মুখের মতো’। কিন্তু বাবার মুখের ভাব তো তিনি ছোটো থেকেই বুঝতে শিখেছেন। কলকাতার দর্শকরা তো ভালো লাগলে সানন্দে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। খারাপ লাগলে জুতো ছুঁড়তেও বাকি রাখে না। কিন্তু এখানে সেসব কিছুই নেই। তবে এর মধ্যেই বেশ কিছু দেশ থেকে ডাক এল। রোম, ব্রাসেলস… ফোনে বাবাকে জানালেন খবরটা। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “আমাকে নিয়ে যাবি তো?”
একটা স্যুটকেস দেবজ্যোতি মিশ্রের সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে বোঝা একটুও কমল কি? ফেরার সঙ্গী হল এক ঝাঁক অভিজ্ঞতা। আর এক অন্য ঋতু। দেশকালের সীমানায় যাঁকে বেঁধে রাখা যায় না। ঋতুপর্ণ একবার বলেছিলেন, “আমরা স্থানে নয়, কালে বাস করি।” কথাটা হয়তো ঠিকই বলেছিলেন। বা হয়তো ঠিক নয়। চিরকালীন বলেও কি হয় না কিছু? সময় পেরিয়ে গেলে কি ঋতুপর্ণের একেকটি সিনেমা হারিয়ে যাবে? না, শিল্প হয়তো স্থান-কাল দুইয়েরই আওতার বাইরে। সেখানে শিল্পীর ছবিটা ওই প্রসেনজিতের তোলা ছবির মতোই অন্ধকার। কিন্তু তাঁর সৃষ্টি আলোয় উজ্জ্বল। শিল্পীর ছায়া… আলোকময় ছায়া…
তথ্যসূত্রঃ ফার্স্ট পার্সন, ঋতুপর্ণ ঘোষ
Powered by Froala Editor