‘সোনার কেল্লা’ই হোক বা ‘জাতিস্মর’— সিনেমা, সাহিত্যে বাঙালি পরিচিত এই ব্যাপারটির সঙ্গে। জাতিস্মর। কখনও মুকুল নিজের গত জন্মের ঘর খুঁজে নিচ্ছে রাজস্থানে, কখনও এক সামান্য লাইব্রেরির কর্মী নিজেকে দেখছেন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি রূপে। কিন্তু বাস্তব জীবনে এইরকম ঘটনা দেখার সুযোগ আমাদের হয় না। শোনারও তেমন সুযোগ আসে না। তবে একেবারেই যে হয় না, তা নয়। ডরোথি এডির গল্প জাতিস্মরের রহস্যকেই আরও একবার উস্কে দেয় আমাদের কাছে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস ডরোথি এডির ঘটনাকে ‘পাশ্চাত্যের জাতিস্মরতার ইতিহাসের অন্যতম চমকপ্রদ ঘটনা’ বলে উল্লেখ করেছিল। কিন্তু ডরোথি এর জন্যই কেবল বিখ্যাত নন। নিজের সময়ের একজন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ছিলেন তিনি। বিশেষ করে মিশরীয় ইতিহাসের প্রতি তাঁর দখল ছিল প্রশংসনীয়। হবে নাই বা কেন! এই মিশরের সঙ্গেই যে তাঁর জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক!
১৯০৪ সালে লন্ডনের এক নিম্ন মধ্যবিত্ত আইরিশ পরিবারে জন্ম হয় ডরোথি এডির। একদম শুরু থেকে কোনও সমস্যা ছিল না। এমন সময় ঘটল দুর্ঘটনা। ডরোথির যখন তিন বছর বয়স, তখন সিঁড়ি থেকে পড়ে যায় সে। ডাক্তারদের সন্দেহ ছিল, হয়ত বাঁচানো যাবে না তাকে। কিন্তু গল্প তো তখনও বাকি ছিল অনেক। নানা প্রতিকূলতার পর অবশেষে বেঁচে ফেরে ছোট্ট ডরোথি। আর তারপর থেকেই আমূল বদলে যায় জীবন। বলা ভাল, রহস্যের পরত তারপরেই আস্তে আস্তে খুলতে লাগল।
দুর্ঘটনার পর, বাড়িতে চলে আসেন সবাই। তখন থেকেই ডরোথির ব্যবহার কেমন অদ্ভুত মনে হতে লাগল বাবা-মা’র। কথায় কথায় মেয়ে বলে ওঠে, ‘বাড়ি যাব’। আর কোন বাড়ি যাবে সে? শুধু তাই নয়, মাঝে মাঝেই অচেনা একটা ভাষায় কীসব বলে ওঠে ছোট্ট মেয়েটি। কিচ্ছু বোঝা যায় না। খ্রিস্ট ধর্মের প্রতিও কেমন একটা বিতৃষ্ণার ভাব জন্ম নিল তার। বদলে আরেকটা জিনিসের উদ্ভব হল, মিশর-প্রীতির। হ্যাঁ, তখন থেকেই মিশরের প্রতি কেমন আত্মিক টান অনুভব করতে লাগল ডরোথি। এমনকি, এর জন্য স্কুলেও সমস্যা তৈরি হয় তার। স্কুল থেকে ব্যান করে দেওয়া হয় তাকে।
এমনই এক সময়, ব্রিটিশ মিউজিয়ামে পরিবারের সঙ্গে যায় ডরোথি। সেখানেই ঘটল পরবর্তী ঘটনা। মিউজিয়ামের ইজিপ্ট গ্যালারিতে গিয়ে মেয়ে যেন হাতে চাঁদ পেল! বারবার বলতে লাগল, এটাই নাকি ওর নিজের ঘর। সমস্ত মূর্তির পায়ের কাছে গিয়ে মাথা ঠেকাতে লাগল। ফ্যারাও সেটি’র মন্দির দেখে নিজের ‘ঘর’ চিনতে পারল ডরোথি। তাহলে কি সে জাতিস্মর?
ক্রমশ সেই কথাটাই যেন পরিষ্কার হতে লাগল। তবে এর ভেতরে বাড়তে লাগল তাঁর মিশর-প্রীতি, মিশরের ইতিহাসের প্রতি তীব্র আকর্ষণ। আর সেটাই নজরে আনলেন প্রখ্যাত মিশরবিদ ওয়ালিশ বাজ। সেই শুরু হল ডরোথি এডির মিশর নিয়ে পড়াশোনা। যত সময় গেছে, আরও বেশি করে ডুব দিয়েছেন সেই ইতিহাসের ভেতর। ভবিষ্যতের মিশরবিদ, ঐতিহাসিক ডরোথির সূচনা সেই থেকেই। তবে পুরনো জন্মের কথা বাদ পড়েনি কোথাও। ডরোথি বললেন, মিশরের দেবতা ‘হোর-রা’ তাঁকে স্বপ্নে দেখা দিচ্ছেন বারবার। জানাচ্ছেন জন্মের কাহিনি। তিনি জানালেন, গত জন্মে তিনি নাকি মিশরের মহিলা পুরোহিত ছিলেন। নাম ছিল ‘বেন্ত্রেশিট’। বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর করুণ পরিস্থিতির।
১৯৩৫ সালে বিবাহসূত্রে ইজিপ্টে উপস্থিত হন তিনি। তারপর থেকে, আমৃত্যু সেখানেই কেটেছে তাঁর। সেখানেই চলেছে তাঁর গবেষণা, কাজ, পড়াশোনা যাবতীয় জিনিস। ১৯৮১ সালে সেখানেই মারা যান তিনি। তবে মৃত্যুতেই কি সব শেষ? আরও একবার জাতিস্মরের ঘটনা উস্কে দিয়ে যায় রহস্যকে। কে জানে, হয়ত আবারও ডরোথি এডি আসবেন এই পৃথিবীতে, অন্য কোনও নামে। তখন কি তাঁর মনে পড়বে এই জন্মের কথা?