একটা ‘তেজস্ক্রিয়’ টুথপেস্ট আর পরমাণু বোমা তৈরির কাহিনি

দাঁতের স্বাস্থ্য পরিষ্কার রাখতে আমাদের সবারই ভরসা একটি টুথপেস্ট। বিজ্ঞাপনী দাপটে সেই টুথপেস্টের সঙ্গে কখনও জুড়ে যায় নিম, কখনও নুন। এসব দেখে দেখেই অভ্যস্ত আমরা। কেমন হয়, যদি এমন একটি টুথপেস্ট আপনার সামনে আসে, যার মধ্যে মিশে আছে ভয়ংকর তেজস্ক্রিয় পদার্থ? আর সেটাই কিনা আপনার দাঁতকে আরও ‘স্বাস্থ্যবান’ এবং ‘মজবুত’ করে তুলবে?

এমন খবর শুনে অবাক এবং ভয়— দুটোই লাগার কথা। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস তো কতই না অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী থাকে! একটা সময় এই ঘটনাটিও বাস্তব ছিল। অর্থাৎ, তেজস্ক্রিয় টুথপেস্ট। সময়টা গত শতাব্দীর কুড়ি থেকে তিরিশের দশক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সব কিছু খুইয়ে বসে আছে জার্মানি। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আরও একটি ভয়ংকর সময়। জার্মানির মসনদে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন অ্যাডলফ হিটলার। তখনই জার্মানির অরগেসেলসশাফট নামের একটি কোম্পানির বিজ্ঞাপন সবার নজর কাড়ল। হলুদ রঙের একটি টিউব, আর তার ওপর লাল অক্ষরে লেখা ‘ডোরামাড’। আর তার নিচে জার্মান ভাষায় লেখা ‘রেডিওঅ্যাকটিভ টুথপেস্ট’! 

সত্যিই কি এভাবে তেজস্ক্রিয় পদার্থ দিয়ে দাঁতের মাজন প্রস্তুত করা সম্ভব? আর সেটা কি আদৌ স্বাস্থ্যকর? এসব নানা প্রশ্ন উঠে আসতে থাকে। ফলস্বরূপ, ডোরামাড নিয়ে চর্চাও বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে এই পেস্টটির নাম। কোম্পানির সূত্রে জানানো হয়েছিল, এই টুথপেস্টে উপস্থিত তেজস্ক্রিয়তা ব্যবহারকারীর দাঁতের স্বাস্থ্য অটুট রাখবে। তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ফলে যাবতীয় জীবাণু মরে যাবে। আর দাঁতের এনামেল অংশকে আরও শক্ত ও উজ্জ্বল করবে। ফলে আপনার হাসিও হবে সুন্দর! 

হাসি তো সুন্দর হল; কিন্তু সামগ্রিক স্বাস্থ্যের কী হবে সেটা অবশ্য বলা হল না। পরবর্তীকালে জানা যায়, এই টুথপেস্টের ভেতর সত্যিই তেজস্ক্রিয় পদার্থ আছে; যদিও তা খুব কম পরিমাণে। আসলে অরগেসেলসশাফট কোম্পানির আসল কাজই ছিল খনি থেকে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ও বিভিন্ন খনিজ উত্তোলন করা, এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন গবেষণায় কাজে লাগানো। সেই সূত্রেই এই বিশেষ টুথপেস্টের ভেতর থোরিয়াম নামক তেজস্ক্রিয় মৌলটি ঢুকে যায়। সেখান থেকেই ডোরামাড হয়ে যায় তেজস্ক্রিয় টুথপেস্ট। 

তবে এই টুথপেস্টটি আরও একটি কারণেও বিখ্যাত ইতিহাসের পাতায়। ডোরামাডের খবর যখন গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল, তখন আমেরিকাও বেশ ঘাবড়ে গেল। ততদিনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সামনে পড়েছে সভ্যতা। আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা ভাবল, জার্মানি যদি সামান্য একটি টুথপেস্টের ভেতর তেজস্ক্রিয় পদার্থ ব্যবহার করতে পারে, তাহলে তো পরমাণু বোমাও বানিয়ে ফেলতে পারবে! আর হিটলারের হাতে পরমাণু বোমা পড়লে তো…! শঙ্কিত হয়ে পড়লেন মার্কিন গোয়েন্দারা। এর অবশ্যম্ভাবী ফল ছিল পরমাণু বোমা নিয়ে নিজেদের গবেষণা আরও দ্রুত শুরু করা। বাকিটা ইতিহাস। একটা টুথপেস্ট বদলে দিল পৃথিবীর ইতিহাস; জন্ম দিল ভয়ংকরতম অস্ত্রের— এমন নিদর্শন কি আগে দেখেছি আমরা!

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
প্রয়াত ইউরেনিয়াম-বিরোধী আন্দোলনের ‘জননী’ কং-স্পিলিটি, শেষ হল মেঘালয়ের একটি অধ্যায়