নব্বইয়ের মহালয়া, রেডিও নয় তবু নস্টালজিয়া

১৯৯৪। ফার্স্ট ইয়ার। গুরু গোবিন্দন কুট্টি একদিন বিকেলে ডেকে পাঠালেন। ‘কিন্তু আমার পরীক্ষা চলছে, কী করে আসব?’ ‘না, তুমি আসবে।’ গুরুর নির্দেশ। আসতে হল। শাড়ি পরে।

ডিরেক্টর সনৎ মাহান্ত, প্রডিউসার শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্তরা বসে আছেন। আছেন গুরুর ছোট-বড় অনেক ছাত্রী। অনেকের সঙ্গে কথা হল। আলোচনা হল। অ্যাসাইনও করালেন। শুধু মেয়েটার সঙ্গে কোনো কথা হল না। তা বলে কোনো আক্ষেপ ছিল না। আসলে জানতেনই না, কী হবে। ফিরে যাবার সময়, ‘তাহলে দুর্গার চরিত্রে কাকে ভাবলে?’ –  এই প্রশ্নের উত্তরে শুধু আঙুলটা ঘুরে গেল মেয়েটার দিকে, ‘কেন? ওকে!’ কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে যাওয়া। মেয়েটার হাঁ হয়ে যাওয়া মুখ। সেইসময় গ্রাম-বাংলার অনেক বাড়িতে সন্ধ্যা-প্রদীপ জ্বলে উঠেছিল কি? শাঁখের শব্দ মিশে গিয়েছিল ‘ধরণীর বহিরাকাশে...’?

আরও পড়ুন
পাকিস্তান আর আরবে দুর্গাপুজো, উর্দুতে লেখা চণ্ডীমন্ত্র

ছোট্ট সংযুক্তা দিদিকে দেখতেন গান গাইতে। ‘আমি কেন নয়?’ বায়না। জেদ। সেই প্রথম নাচের স্কুল। মাত্র আড়াই বছর বয়স। কত্থক। গুরু – পরিমল কৃষ্ণ ঘোষ। জীবন সংঘ কম্পিটিশন। গ্রুপের ফার্স্ট। স্পেশাল অ্যাওয়ার্ড। চলতে থাকল। আসলে, ‘নাচ ছাড়া আমার জীবনে আর কিছু নেই।’

দূরদর্শনে কাজ করেছেন আগেই। সেই রাধা স্টুডিও। চিচিং ফাঁক অনুষ্ঠান। তাই ভয় ছিল না। দায়িত্ববোধ। ‘আমার ওপর যে দায়িত্ব পড়েছে, সেটা কতটা নিষ্ঠা সহকারে করতে পেরেছি, সেটাই দেখেছি।’

অনেক আগের কথা। ১৯৩১। পরাধীন ভারতবর্ষের এক মহালয়ার ভোরে বাঙালি প্রথম রেডিও-তে শুনেছিল ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল, বাণীকুমার। তারপর, অনেকগুলো বছর। একইভাবে।

১৯৯৪-এ মহালয়ার ভোর। প্রথম বাংলা দূরদর্শনে অডিও-ভিসুয়াল। তার আগে একটা ছ’মাসের ওয়ার্কশপ হয়েছিল। ছিল মানসিক প্রস্তুতি। কারণ জানতেন, এই বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠানটির ইমপ্যাক্ট মানুষের মনে কতটা পড়বে। তাই দুর্গা হয়ে ওঠার গভীর যাপন। ফাইট মাস্টাররা দেখিয়ে দিতেন ফাইট। শিখতে হত অভিনয়ও। ‘আটখানা মাটির হাত বেঁধে দেওয়া হত। অসম্ভব ভারী থাকত। গায়ে রীতিমতন ব্যথা এবং কালশিটে পড়ে যেত।’ আর, কখনও শৃঙ্গার-রূপিণী, কখনও অভয়দায়িনী, কখনও সংহার-রূপিণী রূপে বাঙালি তাঁকে পূর্ণ অবয়বে মিলিয়ে নিলো তার মনের কল্পনার দুর্গার সঙ্গে।  

আমরা যারা নব্বইয়ের দশকে জন্মেছি, সাদা-কালো টিভিতে শচীনের ট্রেট ড্রাইভ দেখেছি, দ্রাবিড়ের দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই দেখেছি, ২০০৩-এ বিধ্বংসী অস্ট্রেলিয়ার সামনে গাঙ্গুলির চোখে চোখ রাখা দেখেছি, ঠাকুমার সঙ্গে বসে জন্মভূমি দেখেছি, সন্ধে সাতটার খবরের জন্য কাকার অপেক্ষা দেখেছি, রবিবারের ছায়াছবির জন্য মা-কাকিমার অপেক্ষা দেখেছি কিংবা নিজেরা প্রতি রবিবার শক্তিমানের জন্য অপেক্ষা করেছি, তাদের চোখে আপনিই দুর্গা। আপনার জায়গাটা আজও কেউ নিতে পারেনি। রেডিওতে ভোর চারটে থেকে হবে আর ওটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ডিডি বাংলায় সাড়ে পাঁচটা থেকে হবে – এ-ছিল এক অভ্যাস। বেশ কয়েক বছর আর মহালয়া দেখা হয় না। কিন্তু এই মহালয়ার দিন যখন অনেককে দুর্গা সাজতে দেখি তখন আপনাকে খুব মনে পড়ে। মনে পড়ে আপনার সেই ভয়ংকর তাকানো। ভালো থাকবেন আমাদের স্বপ্ন-বেলার সত্যি দুর্গা, সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়!     

Powered by Froala Editor

More From Author See More