‘দুধপিঠের গাছ’ একটি অবাস্তব স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। সর্বস্তরে বঞ্চিত একটি চূড়ান্ত অভাবী সংসারের অসুস্থ শিশু গৌর, যে কিনা বোবাও নয় আবার ভালো করে কথাও বলতে পারে না – তার বড়ো আকাঙ্খার খাবার দুধ-পিঠে - তার মা একদিন বানিয়েছিল। বন্ধুর পরামর্শে তার একটু টুকরো পুঁতে জল দিয়ে পরিচর্যা করে অঙ্কুর বেরোতেও দেখেছে সে! তার দিদিরা যতই এ-নিয়ে মজা করুক, সে বিশ্বাস করে দুধপিঠের গাছে একদিন দুধপিঠে ফলবেই থরে থরে! বিশেষ করে কাশী-তে যাবার আগে তাদের দিদিমা দুদিনের জন্য তাদের দেখা দিতে এসে যখন সান্ত্বনা দেবার জন্য বলেন যে কাশী নামক জায়গাটিতে বড়ো বড়ো মন্দির ছাড়া অনেক দুধপিঠের গাছ হয়। তার অবোধ শিশু মনে দুধপিঠের স্বপ্নটি সুপ্রোথিত হয়ে যায়। সেও দিদিমার সঙ্গে সঙ্গে কাশী যাবার জন্য তৈরি হয়! দিদিমা তাকে এড়িয়ে যেদিন ট্রেন ধরতে বেরোন - জানতে পেরেই সে দিদিমার সঙ্গ পেতে স্টেশনের পথে দৌড় লাগায় সবার অজান্তে, তার স্বপ্নের দুধ-পিঠে ভরা কাশী নামক স্বপ্নের অজানিত দেশের খোঁজে!
গৌরের এই স্বপ্ন-সন্ধানের ‘এল্ডোরাডো’ আমাদের সকলের মনেই নানা স্তরে, নানা ভঙ্গিতে বাস করে - বিশেষত ভোগবাদী বাজার-অর্থনীতির সতত লোভের হাতছানি দেওয়া সংসারে। কাঙ্খিত রোজকার বা ভোগ্যের আকর্ষণে নিজের দেশ-ঘর-পরিবার ছেড়ে অজানিত-ভবিতব্যের সন্ধানে সুদূরে পাড়ি দিচ্ছে অসংখ্য নানান বয়সের গৌরের দল - গোটা দেশজুড়ে, প্রতিমুহূর্তে! সংসারের ক্ষুধা, অনটন, দারিদ্র্য আর বঞ্চনা সহ্য করার একটা সীমাও তো আছে মানুষের!
ছবিটি শুরুই হয় নদীয়া জেলার একটি প্রায় প্রান্তিক দরিদ্র গ্রামে দোলের আগের দিনের সন্ধ্যায় ‘নেড়া-পোড়া’র আগুন ঘিরে শিশুদের উল্লাসে। এ-শিশুদের উল্লাস আর এ আগুন-টুকুই বোধ হয় এ-গ্রামের প্রাণের একমাত্র মুক্তির উত্তাপ! আগত শীতের কুয়াশা-মোড়া দারিদ্র্যের শীতলতায় মোড়া গৌরদের অতি-দরিদ্র সংসারে দোলের দিনেও একসঙ্গে গুটিসুটি মেরে উদাস চোখে তাকিয়ে বসে থাকে জীর্ণ দাওয়ার কোণের হেঁসেলের আর দরিদ্র মায়ের স্নেহের উত্তাপের আঁচলতলে। তাদের এতটুকু রং-খেলার সামর্থ্যও নেই - আর কেউ তাদের একটু দোলের রংও মাখিয়ে দেয় না!
অসহায় বাবা-মায়ের আর্থিকসঙ্গতিতে কুলায় না তাদের ছোটো-ছেলেটির উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে। ফলে অসহায় মায়ের কথায় ফুটে ওঠে কোনো সাধুবাবার দৈব-ক্ষমতা বা জাগ্রত(!!) দেব-মন্দিরে মানত করার বাসনা। আজকের ভারতবর্ষেও – শাইনিং ইন্ডিয়া-য় যেখানে অতি-উন্নত বৈজ্ঞানিক মারণাস্ত্রের এত রমরমা, সেখানে এই গ্রাম্য-মায়ের ঐ অসহায় দৈব-নির্ভরতা চকিতে মনে করিয়ে দেয় এযুগের সেরা সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতির দর্শনের প্রবক্তা কার্ল মার্কসের ধর্ম-বিষয়ক কিছু মন্তব্যের কথা : কতোটা অর্থনৈতিক সামাজিক নিষ্পেষণ বা শোষনের প্রতিকারহীন শিকারের অসহায়তায় মানুষ আর কিছু না পেয়ে এক কম্পিত ঈশ্বরের আশ্রয় নেয়, যার থেকে সৃষ্ট ‘ধর্ম’ নামক আর এক মহাস্ত্র শোষক বা রাষ্ট্র নামধারী প্রভুদের হাতে উঠে আসে! রাজনীতি বা আর্থ-সমাজনীতির এক ভান-বিহীন, দেখনদারি-শূন্য এক গভীর আন্তবীক্ষণ এই ছবিটির চলনের প্রতিটি পদক্ষেপে জড়িয়ে আছে! কোনো নায়ক নেই, কোনো ভিলেন নেই, আছে শুধু বঞ্চিত দরিদ্র মানুষদের এক অখণ্ড সমাজ-গাথা!
আরও পড়ুন
‘দুধপিঠের গাছ’-এর প্রভাব, মোবাইলেই সিনেমা বানাচ্ছে আড়ংঘাটার ছেলেমেয়েরা
গোটা ছবি জুডেই শ্রীচৈতন্যের নদীয়ার - বাংলার প্রাণপ্রিয় প্রভাতী বা সান্ধ্য নগর-সংকীর্তন ঘুরেফিরে জড়িয়ে রাখে কাহিনির প্রতিটি পরত। আজকের ধামাকাদার চটুল, উত্তেজক ফিল্মি-গীতির তাণ্ডব যে আজকের বাংলার গভীর অন্তঃস্থলকে গ্রাস করতে পারেনি এই কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যেন আমাদের! বারবার আমাদের দেখিয়ে দেয় এই বাজার-অর্থনীতির ভোগসর্বস্ব ইঁদুর-দৌড়ের হানাহানির বাইরেও সহনশীলতার কুয়াশা-মাখা এক প্রতিবাদহীন, অসহায় মাটির-মানুষদের জীবন-চর্যার এবং চর্চার কথা৷ শুধুমাত্র একবেলা দুটি খেতে পারবে এ-কথা মাথায় রেখে মা তার সন্তানদের বাধ্যতামূলক ভাবে স্কুলে পাঠান! সেখানে পর পর কদিন একঘেয়ে খিচুড়ি দেয় শুনে বলেন, “সঙ্গে একটু ভাজা-টাজা দেয় না? তাহলে খেতে ভালো লাগে!” এটা দরিদ্র-মায়ের নিজের অন্তরেরও কথা বোধ হয়, তার নিজেরও ওটি রেঁধে খাওয়ার সঙ্গতি নেই! হয়তো সেই কথা মনে রেখে - মেয়ে একদিন “মিড-ডে মিল'-এর ডিম লুকিয়ে রাখে বাড়িতে গিয়ে বাবা-মার সঙ্গে ভাগ করে খাওয়ার আশায়। কাজে বেরোনোর আগে বাবার পাতে শুধু একটু ভাত, একদলা আলুসেদ্ধ আর নুন মাত্র - তাও আদরের অসুস্থ সন্তান গৌরকে কোলে বসিয়ে দু-গাল জোর করে খাইয়ে দেওয়ার মধ্যে অতলান্ত অভাবের মাঝেও আকাশ-ছোঁয়া পারিবারিক ভালবাসা আর স্নেহের বন্ধনের এক অনির্বচনীয় তৃপ্তির আনন্দে আমাদের বুকটাকে মুচড়ে দেয়। কোনো বাহুল্য নেই, পাঁচ-পয়জার নেই, তথাকথিত নাটকীয়তা নেই - আছে শুধু এই মানুষগুলির প্রতি চলচ্চিত্র নির্মাতা-দলের প্রাণঢালা সশ্রদ্ধ ভালবাসার তীব্রতার একটি আবেগ। যা না থাকলে কোনো সৃজনই ‘শিল্প’ হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। ‘দৃশ্য-শ্রোতৃ’-মাধ্যমে তো নয়ই !
এখানে অভিনয়ের কথা বলার কিছু নেই - কারণ চরিত্রগুলির সঙ্গে মানসিক ঐক্যবোধে সবাই চরিত্র হয়ে গেছেন। এর মাঝে পৃথক ভাবে কারোর কথা উল্লেখ করলে এই সম্মিলিত প্রকৃতার্থে সং-প্রচেষ্টাকে অসম্মান করা হয়। পরিচালক উজ্জ্বল বসুর সৎসাহস ও পরিমিতি-বোধকে বাহবা না দিয়ে উপায় নেই। দৃশ্য-শ্রোতৃ ক্ষেত্রে কোনোও রকম তথাকথিত চলতি বাজারী-গ্রহণযোগ্য কোনো ‘সিনেমাটিক'-চমক এবং সমঝোতা ব্যতিরেকে সিনেমা-ব্যাকরণকে অক্ষুণ্ণ রেখেই - নির্ভেজাল, আদ্যন্ত একটি বাংলা-ছবি, ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’ মার্কা সংস্কৃতির ছায়া না মাড়িয়েও - আমদের মতন ‘বাঙালি’-দের উপহার দেওয়ার জন্য। বিশেষ ধন্যবাদ অবশ্যই চলচ্চিত্র-গ্রাহক শান্তনু-র প্রাপ্য। শান্ত-কুয়াশামোড়া বাংলার ছোট-গ্রামটির বাস্তব নিস্তরঙ্গ প্রকৃতি এবং বহমান জীবনের ছবিটি সঠিক দৃষ্টি-কোণ থেকে গল্পের সঠিক চলনের সঙ্গে মানিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হলেও এই শহরের কোলাহল থেকে আমাদের এক্কেবারে সেইখানেই পৌছে দেবার জন্য। ওই আলোয়, ওই একঘেয়ে পরিবেশের এমন ক্লান্তিময়তাকে ‘কেলাইডোস্কোপিক’ বৈচিত্র্যে দৃষ্টি-সুখকর করে তোলার জন্য। দেখতে যত সহজ, কাজটি কিন্তু সহজ ছিল না। ক্যামেরা নিয়ে এই চ্যালেঞ্জে তিনি সসম্মানে জয়ী হয়েছেন!
আরও পড়ুন
সিনেমার প্রযোজক প্রত্যেকেই; অর্থনৈতিক সংকটেও আশা হারাননি আড়ংঘাটার গ্রামবাসীরা
এ ছবিতে ঝান্ডা নেই, ডান্ডা নেই - তবুও এ এক অসাধারণ শিক্ষণীয় রাজনৈতিক ছবি। সঠিক অর্থে রাজনৈতিক ছবি। যেখানে আছে দেশের মানুষদের - বাঙালিদের সংস্কৃতি আর বাংলার অসহায় মানুষদের মর্মকথা!
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
প্রযোজনার দায়িত্বে গ্রামবাসীরাই; অসংখ্য রূপকথাকে এক সূত্রে বেঁধে দেয় ‘দুধ পিঠের গাছ’