মার্কিন নির্বাচনী যুদ্ধ মানেই হাতি আর গাধার প্রসঙ্গ আসতে বাধ্য। যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রধান দল ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকানদের প্রতীকই যথাক্রমে গাধা এবং হাতি। অথচ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, দুটি প্রাণীরই কিন্তু স্বাভাবিক বাসস্থান আমেরিকা নয়। তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে গেল তারা? ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, এর নেপথ্যে রয়েছেন আমেরিকার তাবড় কার্টুন শিল্পীরা।
উনিশ শতকের শুরুর দিক থেকেই কার্টুনের চল বেড়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। বহুমাত্রার জটিল, রাজনৈতিক বিষয়কে কৌতুকের মাধ্যমে সংবাদপত্রে প্রকাশ করতে থাকেন তৎকালীন কার্টুনিস্টরা। ইতিবাচক দিকগুলো দেখানোর পাশাপাশিই চলত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের কঠোর সমালোচনা। ঠিক তেমনভাবেই জন্ম নিয়েছিল হাতি ও গাধার প্রতীক। হাতি যেমন কখনো স্থিতিশীলতা বোঝাত, তেমনই কখনো বোঝাত আভিজাত্যকেও। তেমনি গাধা আবার কখনো ব্যবহৃত হয়েছে বোকামি, মূর্খতা, কষ্টসহিষ্ণুতার প্রতীক হিসাবে।
এই প্রসঙ্গে যাঁর কথা না বললে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বাদ চলে যায়, তিনি হলেন থমাস ন্যাস্ট। ‘ন্যাস্টি’ শব্দবন্ধের সৃষ্টির সঙ্গেও নাকি জড়িয়ে আছে তাঁর নাম, এমনটাও দাবি করেন অনেকে। ১৮২৮ সাল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের গোঁয়ারতুমির কারণেই কার্টুন আঁকলেন ন্যাস্ট। গাধার শরীর আর অ্যান্ডুর মাথা। এখানেই শেষ নয়। জ্যাকসনকে ‘জ্যাকঅ্যাস’ অভিধাও দিলেন ন্যাস্ট।
তবে থমাস ন্যাস্ট যে ডেমোক্র্যাট বিরোধী ছিলেন চূড়ান্তভাবে, তেমনটা একেবারেই নয়। বরং অত্যন্ত যুক্তিবাদী এবং উদারমনস্ক ছিলেন এই মার্কিন কার্টুনিস্ট। যার ফলস্বরূপ তাঁর ‘নষ্টামি’ থেকে বাদ গেলেন না রিপাবলিকানরাও। তবে অপেক্ষা করতে হল আরও তিন বছর। ১৮৬১ সালে আমেরিকায় শুরু হয়ে গেল গৃহযুদ্ধ। রিপাবলিকান ক্ষমতাশালীরা একছত্র আধিপত্য কায়েম করতেই মরিয়া হয়ে উঠেছিল সে সময়। তাঁদের পুঁজিবাদী মানসিকতাকে ন্যাস্ট প্রতিফলিত করলেন হাতির কার্টুনে। যেন অর্থ আর ক্ষমতায় পিষে দিচ্ছেন তাঁরা সাধারণ মানুষকে।
১৮৮০-র দশকে রাজনৈতিক নেতাদের কাছে অন্যতম ত্রাসে পরিণত হয়েছিলেন ন্যাস্ট। ডান এবং বাম উভয়পন্থীদের কাছেই। বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে ন্যাস্টের কার্টুন নির্বাচনেও যে বেশ ভালো রকম প্রভাব ফেলত, তা না বললেও চলে। আজ থেকে দেড় শতক আগে দাঁড়িয়ে একজন কার্টুনিস্ট গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বাস্তব মূল্যায়ন ফুটিয়ে তুলছেন, তা থেকেই বোঝা যায় কতটা আধুনিক ছিলেন তিনি।
তবে এই আধুনিক উদারমনস্ক প্রতিবাদী সত্তার কারণেই ফলাফলও ভোগ করতে হয়েছিল ন্যাস্টকে। হয়ে উঠেছিলেন সমস্ত রাজনৈতিক নেতাদেরই শ্রেণীশত্রু। ৮০-র দশকের শেষ দিকে ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হন ন্যাস্ট। বন্ধ করে দেওয়া হয় তাঁর উপার্জনের পথও। বাধ্য হয়ে নব্বইয়ের দশকে খ্রিস্টমাসের কার্টুনও এঁকেছেন তিনি। শেষ বয়সে দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেছেন চিকিৎসার অভাবে।
আরও পড়ুন
ভোটে কারচুপি, ডুয়েল কিংবা অতর্কিত মৃত্যু; মার্কিন নির্বাচনের সঙ্গে জড়িয়ে হাজারো কালো অধ্যায়
তবে যে কোনো প্রতিবাদী সত্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হল, বিরোধিতার আগুন সঞ্চার করে দেওয়া অন্যদের মধ্যে। ঠিক সেই জায়গাটাতেই চূড়ান্ত সফল হয়েছিলেন ন্যাস্ট। ন্যাস্টের দেখানো পথেই পরবর্তীকালে বহু কার্টুনিস্ট হেঁটেছেন। হাতি আর গাধার মধ্যে দিয়েই তুলে এনেছেন আরও বিভিন্ন রকম প্রতীকী প্রতিবাদ। যে রীতি অব্যহত আজও। এত এত বছর পেরিয়ে এসে আজও তাঁর তৈরি করে দেওয়া প্রতীক ব্যবহৃত হয়ে আসছে দিব্যই। চার বছর অন্তর প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশন এলেই সারা পৃথিবী জুড়েই সাড়া পড়ে যায় হাতি আর গাধা নিয়ে। চলে ঠাট্টা-তামাশাও। যে দেশের তাদের প্রতীকী জন্ম, সেই দেশের মানুষরাও সাদরে ন্যাস্টের এই মানসিকতাকে গ্রহণ করেছিলেন বলেই হয়তো এখনও পৃথিবীর অগ্রগণ্য দেশ হিসাবেই বিবেচিত যুক্তরাষ্ট্র। এখনও ক্রমাগত দলের বদল হয়ে চলেছে হোয়াইট হাউসে। এই প্রতিবাদ, চর্চা, সমালোচনা না থাকলে হয়তো গণতন্ত্রও পরিণত হয়ে যায় স্বৈরাচারে...
Powered by Froala Editor