ধবধবে সাদা বরফে মোড়া চারিদিক। ইতস্তত মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিছু পাইন গাছ। তার মধ্যে দিয়েই ছুটে চলেছে কুকুরে টানা স্লেজ গাড়ি (Dog Pulled Sled)। এই ছবি দেখলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে গ্রিনল্যান্ড কিংবা আলাস্কার ম্যাপ। হ্যাঁ, নরওয়ে কিংবা সাইবেরিয়াতেও স্লেজের চল আছে ঠিকই, তবে কুকুরে টানা স্লেজ গ্রিনল্যান্ডের (Greenland) ঐতিহ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে এবার এই শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্যকেই হারাতে বসেছে বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপরাষ্ট্রটি।
স্বাভাবিকভাবেই মনের মধ্যে প্রশ্ন উঠবে বাধ্য, কুকুরে টানা স্লেজের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কী সম্পর্ক? তবে কি আর্কটিক অঞ্চলের কুকুররা অবলুপ্তির সম্মুখীন? না, তেমনটা নয়। উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে ক্রমশ গলছে গ্রিনল্যান্ডের বরফ। আর সেই কারণেই তার উপর দিয়ে স্লেজ চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে।
গ্রিনল্যান্ডের পশ্চিম ও পূর্ব উপকূলজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে একাধিক ছোটো-বড়ো জনপদ। মূলত মৎস্যশিকার এবং হরিণ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন এইসকল অঞ্চলের মানুষরা। আর এই শিকারের জন্যই তাঁদের পাড়ি দিতে কয়েকশো মাইল। অবশ্য পথ বলতে আমরা যা বুঝি এই রাস্তা তেমন নয়। যে বরফের ওপর দিয়ে স্লেজ গাড়ি ছোটান গ্রিনল্যান্ডবাসীরা, তা আদতে সমুদ্রে ভাসমান প্রকাণ্ড হিমবাহ। হিমবাহের উপরিতল তো বটেই, জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে এই তুষারচাদর ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে নিচ থেকেও। অর্থাৎ ক্রমশ কমছে তার বেধ। ফলে, স্লেজ ছোটানোর সময় বরফের চাদর ভেঙে হিমশীতল সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে ক্রমশ। বিগত পাঁচ বছরে এধরনের একাধিক দুর্ঘটনাও ঘটেছে পশ্চিম গ্রিনল্যান্ডের ইলুলিসাট অঞ্চলে।
প্রকৃতির এই চেহারা বদলের কারণেই বাধ্য হয়ে স্লেজ গাড়ির ব্যবহার ছাড়ছেন স্থানীয়রা। গ্রিনল্যান্ডের একটি সমীক্ষা বলছে ২০১০ সালে যেখানে ৫ হাজারের বেশি স্লেজ গাড়ি ব্যবহৃত হত গ্রিনল্যান্ডে, এখন সেই সংখ্যাটা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৮০০-তে। কমেছে স্লেজ কুকুরের সংখ্যাও। এমনকি স্লেজে চাপার জন্যই হাজার হাজার পর্যটক পাড়ি দিতেন গ্রিনল্যান্ডের এইসকল জনবিরল অঞ্চলগুলিতে। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কমছে তাদের আনাগোনাও। স্লেজের ব্যবহার কমার আরও একটি কারণ, ধীরে ধীরে সমুদ্রও এগিয়ে আসছে জনপদের কাছে। সবমিলিয়ে বিগত এক দশকেই চোখের সামনে এই প্রাকৃতিক বদল দেখেছেন স্থানীয়রা।
কোপেনহেগেন এবং ডেনমার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি যৌথ সমীক্ষা জানাচ্ছে, সবমিলিয়ে ৯০ শতাংশ গ্রিনল্যান্ডবাসীই মনে করেন জলবায়ু পরিবর্তন বদলে দিচ্ছে তাঁদের দৈনন্দিন জীবনকে। পাশাপাশি ৭৫ শতাংশ উপকূলবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দাদের উপার্জন প্রভাবিত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। গবেষকদের অনুমান, আর কয়েক দশকের মধ্যেই গ্রিনল্যান্ড থেকে চিরকালের মতোই বিদায় নেবে সে-দেশের ঐতিহ্য স্লেজ! এ যেন ভবিতব্য। এখন দেখার কার্বন নির্গমন কমিয়ে, কতটা দূরে সরিয়ে রাখা যায় এই অভিশাপকে…
Powered by Froala Editor