সময়টা ১৯৪২ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা তখন তুঙ্গে। বছর দুয়েক আগেই জাপানের বোমায় তছনছ হয়ে গেছে আমেরিকার পার্ল হারবার বন্দর। তাদের পরবর্তী লক্ষ্য উত্তর অস্ট্রেলিয়ার ডারউইন (Darwin) বন্দর। বোমারু বিমানের সাহায্যে হামলাও করেছে কয়েকবার। তবে প্রতিবারই যেন কীভাবে আগাম সতর্কবার্তা পেয়ে যায় ডারউইনের প্রশাসন। ফলে জাপানিদের ফিরে যেতে হয় খালি হাতে। আর ডারউইনকে ধ্বংসের মুখ থেকে রক্ষার জন্য দায়ী ছিল একটি কুকুর। যার নাম ‘গানার’ (Gunner)।
যুদ্ধবিগ্রহে পশুপাখির ব্যবহার প্রচলিত বহু যুগ থেকেই। একসময় গোপনবার্তা পাঠানো হত পায়রার মাধ্যমে। অস্ত্রবহনের কাজে গাধা বা খচ্চরের ব্যবহার ছিল অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা। গন্ধ শুঁকে শত্রু কিংবা গোপন অস্ত্র খুঁজে বের করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হত কুকুরদের। আর ঘোড়ার ব্যবহারের বিষয়ে কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না আলাদা করে। সম্পূর্ণ বিষয়টি নিয়ে নৈতিকতার দিক থেকে আপত্তি উঠলেও, এই প্রাণীরাও বীরের সম্মান পেয়েছে অনেকক্ষেত্রে। বহু মানুষের প্রাণ বেঁচেছে তাদের সুবাদে। ‘গানার’-এর গল্পটিও সেরকম।
১৯৪২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি জাপানি সেনা প্রথমবার আক্রমণ চালায় ডারউইন বন্দরে। মুহূর্তের মধ্যে তছনছ হয়ে যায় গোটা অঞ্চলটি। সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় একটি সাদা-কালো রং-এর ‘কেলপি’ প্রজাতির কুকুরছানাকে। মাস ছয়েক বয়স তার, সামনের একটি পা ভেঙে টুকরো হয়ে গেছে। বিপদের মধ্যে বসে থরথর করে কাঁপছে সে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে এলেন বায়ুসেনা পার্সি ওয়েস্টকোট (Percy Westcott)। কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে সমস্যায় পড়তে হল তাঁকে। নিয়ম অনুযায়ী, নাম ও নাম্বারহীন কোনো পশুরই চিকিৎসা করা যাবে না সেখানে। ওয়েস্টকোট দ্রুত কাগজপত্রের কাজ মিটিয়ে তার নাম রাখলেন ‘গানার’।
তাররপ থেকে ওয়েস্টকোটের ঘরেই থাকে সে, ঘুমোতেও যায় একই সঙ্গে। সকল সৈন্যদের সঙ্গে বসে সিনেমা দেখে কিংবা কোনো সেনাবিমান উড়াল দিলে বা নামলে দৌড়ে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে আসে। কয়েকদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে গানার মাতিয়ে তুলল পুরো সেনা ব্যারাকটিকে। ততদিনে ওয়েস্টকোট লক্ষ করেছেন আরেকটি বিষয়। গানারের শ্রবণশক্তি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। দূরে কোনো রান্নাঘরে ছুরির আওয়াজে পর্যন্ত কান সজাগ হয়ে যায় তার। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, একশো মাইল দূরে থাকা বিমানের শব্দও সে যেন শুনতে পায় অনায়াসে।
আরও পড়ুন
‘বিপথগামী’ কুকুর লাইকা ও সোভিয়েতের মহাকাশ-অভিযান
একবার ধ্বংস করে গেলেও ডারউইনের বিপদ তখনও কাটেনি। জাপানি সেনারা গোপনে হানা দেয় প্রায়ই। কিন্তু দেখা গেল প্রতিবারই অন্তত কুড়ি মিনিট আগে ডারউইনে বেজে উঠছে বিপদসংকেত। তাদের নিজস্ব যুদ্ধবিমানও আকাশে পাড়ি দিচ্ছে শত্রুর সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য। আর এখানেই গানারের কেরামতি। জাপানি বিমানের শব্দ পেলেই সে আচমকা ডেকে উঠত, ছোটাছুটি শুরু করত গোটা এলাকা জুড়ে। প্রথমদিকে বিষয়টি বুঝতে পারেননি ওয়েস্টকোট ও তার বন্ধুরা। পরে দেখা গেছে গানার প্রতিবারই নির্ভুলভাবে চিনে নিয়েছে শত্রুর আগমনবার্তা। এমনকি নিজেদের ও জাপানি বিমানের মধ্যেও সে পার্থক্য করতে পারত শুধুমাত্র শব্দ শুনে। ১৯৪৫-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত নিজের কর্তব্যে অবিচল ছিল সে। তবে দু-বার নাকি দেরি হয়েছিল তার, তাতেও বিশেষ কিছু বিপদ হয়নি। মূলত, তার জন্যই বারবার প্রাণে বেঁচে গেছিল ডারউইন বন্দর ও সেখানকার মানুষ।
আরও পড়ুন
কুকুরের প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে খোয়ায় দু-হাত, মানুষ মনে রাখেনি যে-কিশোরের বীরত্ব
অবশ্য ১৯৪৩-এ দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ায় বদলি হয়ে যান ওয়েস্টকোট। চাইলে নিয়ে যেতে পারতেন গানারকে। কিন্তু ডারউইনের বিপদের আশঙ্কায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও রেখে যেতে হয় তাকে। আর কোনোদিন দেখা হয়নি দুজনের। গানারের কী হল, সেই বিষয়েও ইতিহাস নীরব। শোনা যায়, ১৯৫৩-তে বারো বছর বয়সে মারা যায় সে। ব্যাস, এইটুকুই। যুদ্ধের পর ওয়েস্টকোট ফিরে আসতে চেয়েছিলেন ডারউইনে। একবার দেখতে চেয়েছিলেন গানারকে। সে স্বপ্নও পূরণ হয়নি তাঁর। যুদ্ধের অসংখ্য ‘নিখোঁজ’ সেনার মতো গানারের নামও রয়ে গেছে শুধু ইতিহাসের পাতায়।
Powered by Froala Editor