বিদ্যুৎপ্রবাহে প্রাণ সঞ্চারিত হচ্ছে মৃত ব্যক্তির শরীরে। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’স মনস্টার। মেরি শেলির লেখা এই উপন্যাসের কথা সকলেই জানেন অল্প-বিস্তর। কেউ বই পড়েছেন, কেউ আবার দেখেছেন অ্যানিমেশন বা সিনেমা। আজও বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কল্পবিজ্ঞানের কাহিনিগুলির মধ্যে অন্যতম এই গল্প। তবে মজার বিষয় হল, এই কাহিনি সাইফাই হলেও, সে-সময় বাস্তবেই এধরনের আশ্চর্য পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছিলেন একদল বিজ্ঞানী।
না, সে-পরীক্ষায় ‘সাবজেক্ট’ হিসাবে ব্যবহার করা হয়নি কোনো মৃত মানবদেহ, তৈরি হয়নি কোনো দৈত্যও। আসলে গবেষকরা এই পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছিলেন গাছের (Trees) ওপর। শুনতে খানিক অবাক লাগলেও সত্যি। বিদ্যুতায়ন (Electrification) গাছের রোগ সারিয়ে তুলতে পারে কিংবা বাড়িয়ে দিতে পারে ফলন— এমনটাই বিশ্বাস করতেন সে-যুগের একদল বিজ্ঞানী। এমনকি তা প্রমাণ করতে রীতিমতো বিভিন্ন যন্ত্র তৈরি করে পরীক্ষানিরীক্ষাও চালিয়েছিলেন তাঁরা।
এই গল্পের শুরু করা যাক জাপান থেকে। আঠারো শতকের শুরুর দিক সেটা, জাপানিদের মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়ে এক আশ্চর্য কাহিনি। মাশরুমের জমিতে বাজ পড়ার পর নাকি হঠাৎ করেই বেড়ে যায় মাশরুমের ফলন। দ্রুত বংশবিস্তারও করে তারা। তবে চাইলেই তো আর আকাশ থেকে বজ্রপাতকে ডেকে আনা সম্ভব নয়। ফলে, জাপানিদের এই বক্তব্যকে কৃত্রিমভাবে প্রমাণ করার বিকল্প পথে অনুসন্ধান শুরু করেন ইউরোপীয় একদল বিজ্ঞানী।
১৭৪০-এর দশক। ফরাসি পদার্থবিদ ও দার্শনিক পিয়ের বার্থোলন তৈরি করে ফেলেন এক আশ্চর্য যন্ত্র। পুরনোদিনের টিভির অ্যান্টেনার আকার যেমন, তাঁর তৈরি এই যন্ত্রটির আকারও ছিল তেমনই। সূচাকার অগ্রভাগের জন্য বাতাস থেকে বৈদ্যুতিক আধান সংগ্রহ করতে পারত এই যন্ত্র। আর সেই আধানকে বৈদ্যুতিক তারের মাধ্যমে তার বাগানের প্রতিটি গাছে সরবরাহ করার ব্যবস্থা করেন বার্থোলন। বার্থোলন নিজের ডায়েরিতে লিখেছিলেন, স্বাভাবিক গাছের তুলনায়, তাঁর বাগানের গাছের ফুল বেশি উজ্জ্বল। পাশাপাশি তা রোগাক্রান্ত হয় অনেক কম। তাঁর কথায়, এই বিদ্যুতায়ন আসলে বিশেষ ধরনের সারের কাজ করে।
শুধু বার্থোলনই নন, পরবর্তীতে ইউরোপের আরও বেশ কিছু গবেষকও কাজ শুরু করেছিলেন এ-ধরনের যন্ত্র নিয়ে। যার মধ্যে আরও একটি উল্লেখযোগ্য যন্ত্র হল ‘ইলেক্ট্রো-ভেজিটো-মিটার’। ব্যাটারি চালিত এই যন্ত্র বীজের অঙ্কুরোদগম, গাছ-ফুল-পাতার বৃদ্ধিতে সাহায্য করে বলেই বিশ্বাস ছিল সে-সময়ের বিজ্ঞানীদের। অবশ্য তা নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি। এই গোটা ব্যাপারটাই ভাঁওতা বলে দাবি করেছিলেন অনেকে।
বিদ্যুতের প্রভাবে গাছের ফলন বৃদ্ধি পায় কিনা, তা আজও প্রমাণ হয়নি সুস্পষ্টভাবে। তবে প্রাচীন এই পরীক্ষানিরীক্ষার সূত্র ধরেই আবিষ্কৃত হয়েছিল ভিন্ন একটি বিষয়। আর তা হল, মানুষের মতো গাছের শরীরও সংবেদনশীল, বৈদ্যুতিক আধানের মধ্যে দিয়েই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ তারা। এই আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন কিংবদন্তি জীববিজ্ঞানী ডারউইন। মাংসাশী উদ্ভিদ আবিষ্কারের পর একটি বিশেষ প্রতিবেদন রচনা করেছিলেন তিনি। লিখেছিলেন, এইধরনের গাছের ক্ষেত্রে শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন বাকি গাছেদের থেকে। মানুষের শরীরে যেমন আঘাত লাগলে স্নায়ুর মধ্যে দিয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছায় সেই অনুভূতি, আবার মস্তিষ্ক থেকেই স্নায়ুর মাধ্যমে প্রবাহিত হয় প্রতিক্রিয়ার নির্দেশ, মাংসাশী গাছেদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা হুবহু এক— এমনটাই বিশ্বাস ছিল তাঁর। পরবর্তীতে তিনি এও লিখেছিলেন, গাছের অভ্যন্তরীণ গঠন বৈদ্যুতিক আধান পরিবহন করতে সক্ষম। ডারউইন যে ভুল ছিলেন না, তা প্রমাণিত হয় কোশপ্রাচীরের গঠন আবিষ্কারের পরে। প্রমাণিত হয়েছিল আলু, পেঁয়াজ কিংবা টমেটোর মতো ফল বিভিন্ন রাসায়নিকের মাধ্যমে সঞ্চিত করে রাখে আধান। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, এর উল্টোটা অর্থাৎ বিদ্যুতের প্রভাবে গাছের বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনাকে ‘অসম্ভব’ বলে দাগিয়ে দেওয়া যায় না মোটেই। কে বলতে পারে, হয়তো আগামীদিনে বিদ্যুতের ব্যবহারেই খাদ্য-সমস্যার সমাধান খুঁজে বার করবে মানুষ!
Powered by Froala Editor