গত বছর থেকেই যখন ধীরে ধীরে প্রকোপ বাড়ছিল করোনাভাইরাসের, সামনে আসছিল একের পর এক ঘরোয়া টোটকা। সেইসঙ্গে মুড়ি-মুড়কির মতো ইচ্ছে মতো ওষুধও খাচ্ছেন মানুষ। বলাই বাহুল্য, এসবের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। ঠিক এভাবেই সম্প্রতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ‘আইভারমেকটিন’ ওষুধটিও। করোনা আক্রান্ত হওয়ার আগে থেকেই কেউ কেউ শুরু করে দিচ্ছেন এই ড্রাগটির কোর্স। কিন্তু সত্যিই কি করোনা প্রতিরোধে সক্ষম এই ওষুধ?
এই ড্রাগের যদৃচ্ছ ব্যবয়ারের বিপক্ষে অধিকাংশ বিজ্ঞানীই। অন্তত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ‘হু’-এর নির্দেশিকা বলছে সেই কথাই। গবেষকরা জানাচ্ছেন, সরাসরি করোনা প্রতিরোধে সক্ষম নয় আইভারমেকটিন। অর্থাৎ, এই ওষুধ জীবনদায়ী নয় মহামারী-পরিস্থিতিতে। এই ড্রাগটি নেওয়ার পরেও অপরিবর্তিত থেকে যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি। কিন্তু এ কথা সত্যি, যে অনেকক্ষেত্রেই করোনা আক্রান্তদের আইভারমেকটিন প্রেসক্রাইব করছেন চিকিৎসকরা। তবে?
“আইভারমেকটিন আসলে অ্যান্টি-হেলমেন্থিক ড্রাগ। দেখা যাচ্ছে, করোনাভাইরাসের বংশবৃদ্ধির জন্য যে আরএনএ পলিমারাইজ এনজাইমটার দরকার হয়, সেই এনজাইমটাকে আটকাচ্ছে এই ওষুধটা। ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি আটকে, মানুষের শরীরে ভাইরাল লোড কমাচ্ছে এটি। সে জন্য বলা হচ্ছে, আক্রান্ত হওয়ার প্রথম পাঁচ দিন আইভারমেকটিন ১২ মিলিগ্রাম করে দেওয়া হবে। কিন্তু আইভারমেকটিন কখনোই করোনা সারায় না। এটা কোনো ম্যাজিক ড্রাগ নয়। শুধুমাত্র রোগের সিভিয়ারিটি, হসপিটাল লোড, মর্টালিটি কমাতে পারে।”
বলছিলেন নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক ডঃ সৌমিতা পাল। তাঁর কথায় স্পষ্ট উঠে এল, সাধারণ মানুষের মধ্যেই তৈরি হয়েছে একটা ভ্রান্ত ধারণা। রেমডিসিভির, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন-এর মতোও আইভারমেকটিন নিয়ে ভুল বার্তা পৌঁছেছে সাধারণের মধ্যে।
আরও পড়ুন
করোনার ভারতীয় স্ট্রেন ‘গ্লোবাল কনসার্ন’, উল্লেখ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-র
তবে শুধুই কি সাধারণ মানুষ? সম্প্রতি গোয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিশ্বজিৎ রানে ঘোষণা করেন, মৃত্যুর হার কমানোর জন্য রাজ্যের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্কদের পরামর্শ দিয়েছেন আইভারমেকটিন খাওয়ার জন্য। সরকারি নির্দেশিকায় জানানো হয়েছে, সমস্ত সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই পাওয়া যাবে এই ওষুধট। কোভিড আক্রান্ত হোক বা না হোক, তা সংগ্রহ করতে পারে যে কেউ। কিন্তু এই ড্রাগের যদৃচ্ছ ব্যবহার বিপদ ডেকে আনবে না তো পরোক্ষভাবে? থেকে যাচ্ছে সেই প্রশ্নই।
আরও পড়ুন
প্রয়াত নেতাজির সহযোদ্ধা লালতি রাম, করোনা কেড়ে নিল আইএনএ সেনাধ্যক্ষকেও
চিকিৎসক সৌমিতা পাল জানালেন, “আইভারমেকটিন কিন্তু পুরোপুরি কন্ট্রাইন্ডিকেটেড। মানে, যাঁদের অ্যাস্থমা আছে, যাঁরা গর্ভবতী বা যে সমস্ত মায়েরা বাচ্চাদের দুধ পান করাচ্ছেন, সেক্ষেত্রে একেবারেই এই ড্রাগ নেওয়া যাবে না। তাছাড়াও যে কোনো ড্রাগেরই বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকেই। সে-জন্য একমাত্র চিকিৎসকদের পরামর্শ নিয়েই ব্যবহার করতে হবে ওষুধ।” সেই ন্যূনতম সতর্কতা যে গড়ে উঠছে না বৃহত্তর ক্ষেত্রে, তা একপ্রকার স্পষ্ট।
আরও পড়ুন
সীমান্ত ছেড়ে, করোনা মোকাবিলায় এবার সামিল সামরিক চিকিৎসকরাও
২০১৯ সালের একেবারে শেষের দিকে ধরা পড়েছিল নোভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। তারপর থেকে অতিবাহিত হয়েছে মাত্র দেড় বছর। এত কম সময়ে একটা সম্পূর্ণ নতুন রোগের বিষয়ে গবেষণা ও প্রমাণ সংগ্রহ করা কার্যত অসম্ভব। তাই ক্রমাগত চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। বদলাচ্ছে চিকিৎসার গাইডলাইনও। ঠিক সেভাবেই ‘হু’-সহ একাধিক স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, আইভারমেকটিনের ‘জীবনদায়ী’ কোনো প্রমাণ এখনও পাননি বিশেষজ্ঞরা। ফলত, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া যে এই ওষুধ খাওয়া ভিত্তিহীন— সে ব্যাপারে সচেতন হতে হবে সাধারণ মানুষকেই…
Powered by Froala Editor