রেমডিসিভির মানেই করোনা-জয় নয়, জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা

“এটা একটা অফ-লেভেল ড্রাগ। কিন্তু সরাসরি ব্যবহারের জন্য কোনো সংস্থা থেকেই আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়নি। কিছু গবেষণা এবং এভিডেন্সের মাধ্যমে দেখা গেছে কিছু ক্ষেত্রে মডারেট এবং সিভিয়ার পেশেন্টদের ওপর যদি এটা ব্যবহার করতে পারি, তাও সংক্রমণের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে— তাহলে ভাইরাল রেপ্লিকেশনটা কমানো যায়। তবে রেমডিসিভির না দিলে যে পেশেন্টের অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে, বিষয়টা একেবারেই এমনটা নয়।”

বলছিলেন কোঠারি হাসপাতালের চিকিৎসক ডাঃ পুরুষোত্তম চক্রবর্তী। প্রসঙ্গ রেমডিসিভির। গোটা দেশে বর্তমানে চলছে এক অঘোষিত মেডিক্যাল এমার্জেন্সি। স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য হাহাকার চারিদিকেই। হাসপাতাল শয্যা, অক্সিজেন, ওষুধ— সবকিছুরই চাহিদাই প্রতুল। আর এই স্বাস্থ্য সংকটের মধ্যে আরও প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে রেমডিসিভিরের চাহিদা। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ স্ট্যাটাসে ছেয়ে গেছে এই ‘সঞ্জীবনী’-র নাম। এমনকি গুগলে সার্চ করা প্রথম দশটি শব্দের মধ্যেও জায়গা করে নিয়েছে রেমডিসিভির। আর এই ব্যাপক চাহিদার জন্য চলছে দেদার কালোবাজারি। প্রতি ভয়াল রেমডিসিভির কোথাও বিক্রি হচ্ছে কুড়ি হাজার টাকায়, কোথাও বা আরও বেশি। যেখানে তার আসল দাম সাড়ে তিন হাজারের মধ্যেই।

তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, খোলা বাজারে রেমডিসিভিরের বিক্রি সম্পূর্ণ আইন বিরুদ্ধ। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলির এই ড্রাগ সরাসরি বিক্রি করার কথা কেন্দ্র সরকারকে। প্রতিটি রাজ্যে এই ওষুধ সরবরাহ করার দায়িত্ব কেন্দ্রের। সেখান থেকেই তা সরাসরি যাওয়ার কথা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে। যেহেতু এই ড্রাগ ব্যবহারের নির্দিষ্ট অনুমোদন দেয়নি কোনো স্বাস্থ্য সংস্থাই, তাই একমাত্র সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকই ঠিক করে দেবেন কোনো রোগীর ওপর রেমডিসিভির ব্যবহৃত হবে কিনা। যে কথাটা শুরুতেই মনে করিয়ে দিয়েছিলেন পুরুষোত্তমবাবু। কিন্তু তেমনটাই যদি হয়ে থাকে তবে খোলা বাজারে কেন বিক্রি হচ্ছে এই ওষুধ?

সমস্যার মূল সূত্রপাত হচ্ছে হাসপাতাল থেকেই। ওষুধের স্টক নেই জানিয়ে হাত তুলে নিচ্ছে অনেক হাসপাতালই। বরং রোগীর পরিবারের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রেস্ক্রিপশন, স্লিপ। তাঁদেরকে ওষুধ সংগ্রহ করে এনে দিতে বলা হচ্ছে বাইরে থেকে। অন্যদিকে রোগীর এই অসহায়তাকে কাজে লাগিয়ে রমরমা ব্যবস্তা চালিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা। সাম্প্রতিক সময়ে এই ধরনের ঘটনা সামনে এসেছে একাধিকবার। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় রেমডিসিভিরের অভাব সত্যিই কি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে কোভিড আক্রান্তদের? অথবা মুমূর্ষু রোগীকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে এই তথাকথিত ‘সঞ্জীবনী’?

আরও পড়ুন
দৃষ্টিহীনদের কোভিড-চিকিৎসা এবং টিকাকরণে ভরসা আদালতই?

কোঠারি হাসপাতালের আরেক চিকিৎসক ডাঃ পলাশ রায় বিশ্লেষণ করলেন পুরো বিষয়টি, “প্রথম ওয়েভে রেমডিসিভির খুব ভালো চলেছিল। মাঝে অন্য কিছু ড্রাগ অ্যাড হয়। এইবার সেই চাহিদা আকাশ ছুঁয়েছে আবার। মানুষের মধ্যে কোনোভাবে এমন একটা মেসেজ চলে গেছে, যে রেমডিসিভির যে পেশেন্ট পাচ্ছেন, তিনি বাঁচছেন। না হলে বাঁচছেন না। এখন করোনার সবথেকে বড়ো ফেটাল কমপ্লিকেশন হল ব্লাড ক্লটেজ। যেদিক থেকে বিষয়টা মাল্টি-অর্গান ফেলিওরের দিকে যায়। তাই সিভিয়ার পেশেন্টদের ক্ষেত্রে অন্যতম দুটি হাতিয়ার হল স্টেরয়েড এবং অ্যান্টি-কোয়াগুলেন্ট। অথচ, এই ওষুধগুলোর কোনোরকম ঘাটতি নেই বাজারে। এই ওষুধটি অবশ্যই প্রয়োজনীয়, লাভও আছে ব্যবহারে। কিন্তু ব্যবহারের নির্দিষ্ট কিছু জায়গা আছে। একশো জন রোগী এলে সকলকেই যে রেমডিসিভির দিতে হবে, তেমনটা নয়। কিন্তু মানুষের মনে এমন একটা জায়গা করে নিয়েছে এই নামটা, যে সেখান থেকেই সূত্রপাত এই কালোবাজারির।” 

আরও পড়ুন
‘আমরা খেতে পেলে কোভিড-আক্রান্তরাও খেতে পাবেন’; লড়ছে বাঙালির রান্নাঘরও

তবে শুধু কালোবাজারির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় রোগীদের হয়রানি। সেইসঙ্গে দেদার বিকোচ্ছে ভুয়ো ওষুধও। রেমডিসিভিরের নামের জাল ওষুধ সংগ্রহ করে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। পুরুষোত্তমবাবু অনুরোধের সুরেই জানালেন, “পেশেন্টদের পরিবারকে এটাই বলার, হাহাকার বা টেনশনের মধ্যে না গিয়ে বাইরে থেকে ওষুধ না কেনাটাই শ্রেয়। বরং হসপিটালের থ্রু-তে গেলেই একমাত্র জেনুইন ড্রাগটা পাবেন। এই জায়গাটায় আমাদের একটু সতর্ক হওয়া উচিত।”

আরও পড়ুন
কোভিড-মোকাবিলায় ডিজিটাল তথ্যভাণ্ডার, যোগাযোগ বুনছে বাংলার তরুণ প্রজন্ম

রেমডিসিভিরের এই বাড়বাড়ন্ত চাহিদার জন্য জরুরি অবস্থায় বাংলাদেশ থেকে ৫০ হাজার ডোজ কেনার জন্য উদ্যোগী হয়েছে ভারত সরকার। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় এর পরেও কি চাহিদা কমবে রেমডিসিভিরের? নিয়ন্ত্রণে আসবে কালোবাজারি? “ভিরাফিন বলে একটা নতুন ওষুধ আসছে বাজারে। এই সদ্য সদ্য সেটা অ্যাপ্রুভড হয়েছে ভারতে। এখনও পর্যন্ত মার্কেটে আসেনি। এটা রেমডিসিভিরের একটি সাবস্টিটিউট। তবে সুবিধা হল, এটা রেমডিসিভিরের মতো শুধুমাত্র হাসপাতালে ব্যবহৃত হয় না। চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখতে হয় না পেশেন্টদের। বাড়িতেই দেওয়া যায়। এখন দেখা যাক, ওই ওষুধটা বাজারে এলে মানুষের কনসেন্ট্রেশন শিফট হয় কিনা”, জানান দিলেন ডাঃ পলাশ রায়। তবে এরপরেও কালোবাজারি রুখতে বিশেষভাবে উদ্যোগ নিতে হবে প্রশাসনকে। না হলে এই কঠিন পরিস্থিতি হয়ে উঠবে আরও ঘোরতর…

Powered by Froala Editor

More From Author See More