অপমানে আত্মহত্যা করেছিলেন ডঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়, ৩৮ বছর পর যেন 'সুবিচার' পেলেন তিনি

১৯৭৮ সালের ৩ অক্টোবর। জন্ম নিল ভারতের প্রথম টেস্টটিউব বেবি ‘দুর্গা’। ভালো নাম কানুপ্রিয়া আগরওয়াল। আর তার জন্মের পিছনে প্রধান ভূমিকা ছিল যে ব্যক্তির, তিনি একজন বাঙালি চিকিৎসক। নাম ডঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ভারতের প্রথম টেস্টটিউব বেবির জন্মদাতা।

মাত্র ৬৭ দিন আগেই দুই ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক প্যাট্রিক স্টেপটো ও রবার্ট জিওফ্রি এডওয়ার্ডস-এর তত্ত্বাবধানে জন্ম নিয়েছিল বিশ্বের প্রথম টেস্টটিউব বেবি। ডঃ মুখোপাধ্যায়ের কৃতিত্ব বিশ্বে দ্বিতীয়। তবে তাতে এতটুকুও খাটো হয় না তাঁর সাফল্য। ইউরোপ-আমেরিকা নয়, খোদ কলকাতায় বসে নিজের গবেষণা চালিয়েছিলেন তিনি।

আরও পড়ুন
আইনস্টানের রিলেটিভিটির প্রথম ইংরেজি অনুবাদ বেরোয় কলকাতা থেকেই, অনুবাদক সত্যেন বসু আর মেঘনাদ সাহা

অথচ জীবদ্দশায় স্বীকৃতি পাননি তিনি। নিজের দেশেই অবহেলা ও অপমানের স্বীকার হতে হয় তাঁকে। তাঁর আবিষ্কারকে নস্যাৎ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন পশ্চিমবঙ্গেরই একদল চিকিৎসক। সঙ্গে মত ছিল প্রশাসনেরও। তাঁর গবেষণা খতিয়ে দেখার জন্য বসে তদন্ত কমিটি। সেই কমিটিতে ছিলেন এমন সব সদস্য, যাঁদের ফার্টিলিটি বা প্রজনন নিয়ে ধারণাই ছিল না বিশেষ। সেই তদন্ত কমিটি ডঃ মুখোপাধ্যায়ের সাফল্যকে  ভুয়ো বলে দাবি করে।

বিদেশ থেকে কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ডঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে। এমনকি, জাপানের এক বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণ নিজেদের খরচে ডঃ মুখোপাধ্যায়কে নিয়েও যেতে চেয়েছিল, তাঁর আবিষ্কার সম্পর্কে বক্তব্য রাখার জন্য। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। তাঁকে যেতে তো দেওয়া হয়ইনি, উল্টে তাঁর বিদেশযাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়।

এখানেই শেষ নয়। ডঃ মুখোপাধ্যায়কে প্রথমে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে, তারপর আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে বদলি করা হয়। সব শেষে, রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অব অপথ্যালমোলজি-র চক্ষু বিভাগে স্থানান্তরিত করা হয় তাঁকে। এই অপমান তিনি সইতে পারেননি। তাঁর সারাজীবনের কাজ হরমোন গ্রন্থি নিয়ে। আর তাঁকে কিনা বদলি করা হল চক্ষু বিভাগে। এই অপমানের ভার বইতে পারেননি তিনি। ১৯৮১ সালের ১৯ জুন আত্মহত্যা করেন ডঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়।

আরও পড়ুন
যে বাঙালি বিজ্ঞানীর গবেষণা ধরে এগিয়েছিলেন স্টিফেন হকিং

জীবদ্দশায় যে স্বীকৃতি তিনি পাননি, পরবর্তীকালে ডঃ আনন্দ কুমারের নিরলস প্রচেষ্টা তাঁকে সেই স্বীকৃতির কাছে পৌঁছে দেয়। ‘ভারতের টেস্টটিউব বেবির জনক’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন ডঃ মুখোপাধ্যায়।

তবে এখানেই শেষ নয়। ডঃ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণার কেন্দ্র ছিল কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল, সংক্ষেপে এনআরএস হাসপাতাল। এই এনআরএসেই বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকার চালু করতে চলেছে সরকারের প্রথম টেস্টটিউব বেবি বা আইভিএফ সেন্টার। আগামী জানুয়ারি থেকে চালু হবে এই পরিষেবা।

আরও আনন্দের বিষয় হল, চিকিৎসা হবে সম্পূর্ণ নিখরচায়। বর্তমানে অনেক দম্পতিই সন্তানহীনতায় ভোগেন। অথচ সবার আর্থিক সামর্থ্য সমান নয়। টেস্টটেউব বেবি পরিষেবার সুযোগ নিতে পারেন না অনেকেই। এনআরএসের এই সেন্টার অনেক দম্পতির মুখেই হাসি ফোটাবে। পরিকাঠামোর কাজ ইতিমধ্যে এগিয়েছে অনেকটাই।

রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা জানিয়েছেন, এই উদ্যোগটি পরোক্ষে ডঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘও। মৃত্যুর প্রায় ৩৮ বছর পরে, হয়তো শ্রেষ্ঠ স্বীকৃতিটি পেলেন ডঃ মুখোপাধ্যায়। খোদ তাঁর গবেষণাস্থলেই।

ইতিহাস কখনও কখনও সুবিচারও করে, তাই না?