১৯৯২ সাল। কলকাতার খিদিরপুরে প্রথমবারের জন্য স্থানীয় কোনো মানুষ আক্রান্ত হলেন এইচআইভি ভাইরাসে। রেডিও, টেলিভিশনে শুরু হল এইডস নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রচার। কিন্তু যৌনকর্মীদের জন্য আলাদা করে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হল না প্রশাসনের পক্ষ থেকে। অথচ, এই মারণ ভাইরাসের সংক্রমণের সম্ভাবনা তাঁদের মধ্যেই সব থেকে বেশি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যক্তিগত উদ্যোগেই প্রচার শুরু করলেন এক বাঙালি চিকিৎসক। ডাঃ স্মরজিত জানা। কিন্তু এমন এক প্রচার উদ্যোগে তো প্রয়োজন ব্যাপক সংখ্যক স্বাস্থীকর্মীর। তিনি সেই দায়িত্ব দিলেন যৌনকর্মীদেরই। খিদিরপুরের বলাকা ক্লাবের ছোট্ট ক্লাবঘরই হয়ে উঠল অফিস।
এইডস নিয়ে শুধু গবেষণাই নয়, তা প্রতিকারে মাঠে নেমে এভাবেই লড়াই শুরু করেছিলেন ডাঃ স্মরজিত জানা। তথাকথিত নিষিদ্ধপল্লীর উন্নয়নে নিয়েছিলেন একাধিক উদ্যোগ। গতকাল করোনাভাইরাস কেড়ে নিল খ্যাতনামা চিকিৎসক ও ‘দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতি’-র প্রতিষ্ঠাতার প্রাণ। বেশ কিছুদিন আগেই কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। আশঙ্কাজনক অবস্থাতেই তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে। তবে ব্যর্থ হল সকল প্রচেষ্টা। গতকাল দুপুর ১টা নাগাদ হাসপাতালেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর।
১৯৭৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিবিএস পাস করেন চিকিৎসক স্মরজিত জানা। কলকাতার স্কুল অফ ট্রপিকাল মেডিসিন থেকে স্নাতকোত্তর। এমডি করার পর যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অতিমারী এবং জনস্বাস্থ্য নিয়ে অধ্যায়ন করেন তিনি। বিদেশে বিলাসবহুল জীবনের সুযোগ থাকলেও তিনি ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়। হয়ে উঠেছিলেন সাধারণের চিকিৎসক। পরবর্তীতে সমাজের পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের আধিকার বুঝে নেওয়ার একাধিক আন্দোলনের বীজও রোপণ করেছিলেন তিনি।
সেই লড়াইয়ের পথ চলা শুরু হয়েছিল ১৯৯২ সালে। এইডসের সংক্রমণ থেকে যৌনকর্মীদের বাঁচাতে পথে নামলেন স্মরজিত। তবে নিষিদ্ধপল্লীতে কাজ করতে গিয়ে তিনি কাছ থেকে দেখলেন লালবাতি এলাকার মানুষদের বাস্তব জীবন। কাছ থেকে উপলব্ধ করেন নাবালিকা পাচার, নাগরিকত্বের দাবির মতো সমস্যাগুলিকে। অনালোচিত সেই বিষয়গুলিকেই তিনি তুলে আনেন গোটা দেশের কাছে। যৌনপল্লীর উন্নয়নের জন্য ১৯৯৫ সালে তৈরি করেন দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতি। শুরু হয় মানবাধিকারের জন্য লড়াই।
আরও পড়ুন
সীমান্ত ছেড়ে, করোনা মোকাবিলায় এবার সামিল সামরিক চিকিৎসকরাও
তবে শুধুই কি যৌনকর্মীদের অধিকারের স্বপক্ষে লড়াই? “অনেকেই সেক্স-ওয়ার্কারস মুভমেন্টে ওনার অবদানের কথা বলেন। কিন্তু রূপান্তরকামী মানুষদের আন্দোলনে ওনার যে ভূমিকা ছিল সেটা কাছ থেকে না দেখলে বোঝা সম্ভব নয়। আজ থেকে পনেরো-কুড়ি বছর আগে যখন রূপান্তকারমী আন্দোলন শুরু হয় তখন স্যরই আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন”, বলছিলেন ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ ট্রান্সজেন্ডার অ্যান্ড হিজরা ইন বেঙ্গল’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যা রঞ্জিতা সিনহা।
আরও পড়ুন
রক্তনালিতে 'বিষ' ছড়ায় করোনার স্পাইক প্রোটিন!
“আমি এলজিবিটি আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে থাকতে পারি, কিন্তু এই লড়াইটা আমার শেখা দুর্বারের যৌনকর্মী আন্দোলন থেকে। মাস্টার্স করার পর রিসার্চের কাজ করি যৌনকর্মীদের ওপর। সেই সুযোগটা করে দিয়েছিলেন স্মরজিৎ জানা। বলতে গেলে উনি ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকার বুঝে নেওয়ার সেই সুযোগটা করে দিয়েছিলেন যৌনকর্মী আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই। নিজেদের জন্য বলার সুযোগ করেছিলেন আন্তর্জাতিক মঞ্চে”, রঞ্জিতা সিনহার স্মৃতিচারণায় ফিরে ফিরে আসছিল এসব কথাই।
আরও পড়ুন
করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গে বিপর্যস্ত নেপাল, আত্মসমর্পণ সরকারের
বলতে গেলে সমাজের সমস্ত উপেক্ষিত মানুষদেরই তিনি বেঁধে রেখেছিলেন একটা জায়গায়। সমাজকর্মী পারমিতা চৌধুরী জানালেন, “যৌনকর্মীদের, গৃহশ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে উনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ওঁর সবথেকে বড়ো কৃতিত্ব হল যৌনকর্মীদের জন্য সমবায় ব্যাঙ্ক তৈরি করা। সেই সময় যৌনকর্মীদের কোনো সঞ্চয়ের উপায় ছিল না। সবটাই নিয়ন্ত্রণ করত তৃতীয় পক্ষের ব্যক্তিরা। এই উদ্যোগে অসম্ভব উপকৃত হয়েছিলেন যৌনকর্মীরা। আর যে কোনো বিষয়েই উনি প্রত্যেকের বক্তব্য শুনতেন মন দিয়ে। প্রত্যেককে সম্মান দিয়ে ‘আপনি’ বলেই কথা বলতেন স্যর।”
২০১৭ সালে কলকাতার যৌনপল্লীতে দুর্গাপুজো শুরুর পিছনেও অবদান রয়েছে ডাঃ জানার। এককথায় তাঁর কাজের তালিকার শেষ নেই কোনো। কলকাতা তথা বাংলার তো বটেই, বৈশ্বিক স্তরেও জনস্বাস্থ্যের জন্য বার বার সরব হয়েছেন তিনি। চেয়ারপারসন হিসাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন ১৯তম বিশ্ব এইডস সম্মেলনে। প্রতিনিধিত্ব করেছেন জাতিসংঘে স্বাস্থ্য কমিটিতেও।
গত বছর যখন মহামারীর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে, তখনও যৌনকর্মীদের সহায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তৎপরতার সঙ্গেই শুরু হয়েছিল সচেতনতা প্রচার। মাস্ক, স্যানিটাইজার এবং অন্যান্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন যৌনকর্মীদের দিকে। কেই বা জানত এই অতিমারীর সঙ্গে লড়াই করতে গিয়েই প্রাণ হারাবেন তিনি? এই ইন্দ্রপতনে শোকস্তব্ধ দুর্বার মহিলা সমিতির সদস্যারা। অভিভাবকের স্থান যে শূন্য হয়ে গেছে, তা মেনে নিতে পারছেন না কেউ-ই…
Powered by Froala Editor