১৯৮৪ সাল সেটা। বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হল এক বাঙালি চলচ্চিত্রকারের ছবি। সত্যজিৎ রায়ের ‘ঘরে-বাইরে’। আর ওই একই বছরে চলচ্চিত্রে জাতীয় পুরস্কার পেল আরও এক বঙ্গসন্তানের তৈরি ছবি। ‘ভোম্বল সর্দার’। পরিচালক? নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায় (Nripen Gangopadhyay)। না, সেই অর্থে সাধারণ দর্শকমহলে বিপুল জনপ্রিয়তা পাননি তিনি। বা, বলা ভালো নিজেকে লাইমলাইটের আড়ালেই রেখেছেন চিরকাল। ১৯৮৪-র জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁর কাছে এসে পৌঁছাল একটি টেলিগ্রাম। প্রেরক, খোদ ভারত সরকার। জরুরি ভিত্তিতে তাঁকে ‘ভোম্বল সর্দার’ ছবিটি পাঠাতে হবে সরকারি দপ্তরে। কেননা তাঁর এই ছবি নাকি নির্বাচিত হয়েছে বার্লিনের প্রতিযোগিতামূলক বিভাগে।
হ্যাঁ, সত্যজিতের ‘ঘরে-বাইরে’-র পর দ্বিতীয় বাংলা চলচ্চিত্র হিসাবে বার্লিনে পাড়ি দিয়েছিল ‘ভোম্বল সর্দার’ (Bhombol Sardar)। বলা যেতে পারে, তৈরি করেছিল এক সোনার ইতিহাস। সত্যজিতের রেকর্ড স্পর্শ করেছিলেন নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়। এ-কথা নিজেই উল্লেখ করেছিলেন সত্যজিৎ। প্রভূত প্রশংসা করেছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের আরেক মহীরুহ মৃণাল সেনও। চলচ্চিত্রের সেই সোনালি অধ্যায়েই ইতি পড়ল এবার। গতকাল ৯৪ বছর বয়সে অনন্তের দিকে পাড়ি দিলেন পরিচালক নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়, ওরফে ন্যাপাদা। দীর্ঘদিন থেকেই ভুগছিলেন বার্ধক্যজনিত অসুখে। দানা বেঁধেছিল ক্যানসারও। তার ওপরে কয়েকদিন আগে আক্রান্ত হয়েছিলেন ম্যালেরিয়ায়। প্রাথমিকভাবে সেই ধাক্কা সামলে উঠতে পারলেও, দীর্ঘস্থায়ী হল না লড়াই। গতকাল রাত ৯টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলার অন্যতম চলচ্চিত্র পরিচালক।
আজীবন কলকাতানিবাসী হলেও, নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম পূর্ববঙ্গের ফরিদপুরে। ১৯২৭ সালের ১৫ আগস্ট। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে চলে আসা এপার বাংলায়। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য নিয়ে স্নাতকস্তরের পড়াশোনা। জড়িয়ে পড়া বামপন্থী রাজনীতিতে। ততদিনে অবশ্য বেজে উঠেছে দেশভাগের দামামা। অস্থির পরিস্থিতি দুই বাংলাতেই। ছড়িয়ে পড়েছে দাঙ্গা।
আর দেশভাগের সেই পটভূমিতেই প্রায় শুনশান হয়ে গেল কলকাতার সিনে-পাড়া। কারণ, সেখানকার অধিকাংশ কর্মীই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ফলে, এপার বাংলা ছেড়ে অধিকাংশ টেকনিশিয়ানই পাড়ি জমালেন পূর্ববঙ্গে। বা, বলা ভালো পূর্ব পাকিস্তানে। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রি তো কর্মীর অভাবে আর থমকে থাকতে পারে না। ফলত, শুরু হল সেই শূন্যস্থান পূরণের তোড়জোড়। এভাবেই কলেজ পড়ুয়া নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে সুযোগ এসেছিল চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় কাজ করার। চলচ্চিত্র সম্পর্কে তখনও তাঁর ধারণা আর পাঁচজন সাধারণ দর্শকদের মতোই। ঠিক হল, কাজ করতে হবে বিনা পারিশ্রমিকে। পরে কাজে পারদর্শী হয়ে উঠলে মিলবে বেতন। সেই শর্তেই তিনি ল্যাবরেটরি অ্যাসিসটেন্ট হিসাবে নাম লেখালেন ভারতলক্ষ্মী স্টুডিও-য়। সেটা স্বাধীনতার ঠিক পরপরই।
আরও পড়ুন
সত্যজিৎ রায় নামাঙ্কিত চলচ্চিত্র পুরস্কার পেতে চলেছেন মার্টিন স্করসেস এবং ইসৎভান জাবো
চলচ্চিত্র জগতের অন্দরমহলে কাজ করার সুবাদেই তাঁর সঙ্গে খানিক আকস্মিকভাবেই ‘আলাপ’ হয় মৃণাল সেনের। তারপর অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব। প্রতিদিন নিয়ম করেই হাজিরা দেওয়া ‘প্যারাডাইস ক্যাফে’, মানে আজকের প্যারামাউন্টের আড্ডায়। কে থাকত সেই আড্ডায়? ঋত্বিক ঘটক, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী— এক কথায় যাকে বলে চাঁদের হাট। ল্যাব অ্যাসিসটেন্ট থেকে পরিচালক হয়ে ওঠার জার্নি বোধ হয় শুরু হয়েছিল ‘প্যারাডাইস ক্যাফে’-র সেই আড্ডার হাত ধরেই।
আরও পড়ুন
যৌনপল্লীর জীবন থেকে চলচ্চিত্র জগতে পুরস্কারপ্রাপ্তি, রোমাঞ্চকর জীবন নলিনী জামিলার
১৯৫৬ সালে হীরেন বসু-পরিচালিত ছবি ‘একতারা’-তে প্রথম সহকারী পরিচালক হিসাবে হাতেখড়ি নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়ের। তারপর ‘রাজধানী থেকে পালিয়ে’, ‘পার্সোনাল এ্যাসিস্টেন্ট’, ‘অভিযান’-এর মতো ছবিতে কাজ। ততদিনে অবশ্য টলিপাড়ায় যথেষ্ট পরিচিত মুখ তিনি অন্যদিক থেকেও। হ্যাঁ, সিনে-কর্মীদের হয়ে আন্দোলনের অন্যতম মুখ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তখনও পর্যন্ত নতুন কর্মীদের কাজ করতে হত বেতন ছাড়াই। দাবি উঠল, বিনাবেতনে কাজ করবে না কোনো টেকনিশিয়ানই। আন্দোলনকারীদের নিয়ে গড়ে উঠল ‘সিনে টেকনিশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল’ সংগঠন। ভারতলক্ষ্মী স্টুডিও-র প্রতিনিধি হিসাবে সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়। ব্যর্থ হয়নি সেই আন্দোলন।
আরও পড়ুন
আজকের চলচ্চিত্র নিয়ে কিছু ভাবনা
স্বতন্ত্র পরিচালক হিসাবে নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম কাজ অবশ্য এরও প্রায় এক দশক পরে। ১৯৬৩ সাল সেটা। মুক্তি পেল তাঁর তৈরি প্রথম ছবি ‘শেষ প্রহর’। অর্থনৈতিক হিসাবে সেই ছবি অবশ্য লাভের মুখ দেখেনি। কিন্তু শুধুমাত্র অর্থের জন্যই কি ছবি করা? না, তেমনটা কোনোদিনই ভাবেননি পরিচালক নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়। বরং, যে কাজের মধ্যে আনন্দ রয়েছে, রয়েছে সততা— সেটাকেই তিনি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন সেলুলয়েড পর্দায়। তার জন্য অবশ্য মাশুলও গুনতে হয়েছে তাঁকে।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞানী এডিসনের পরিচালনাতেই ‘প্রথম’ ভারতীয় চলচ্চিত্র, নায়ক এক বাঙালি!
১৯৬৬ সাল সেটা। নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়, সৌমেন্দু রায়-সহ চার জন চলচ্চিত্রব্যক্তিত্ব মিলে গড়ে তুলেছিলেন স্বতন্ত্র কোম্পানি ‘গ্রাফিক ডকুমেন্ট্রি’। এখান থেকেই প্রকাশ পেয়েছিল ‘গ্লিম্পসেস অফ ওয়েস্টবেঙ্গল’, ‘হ্যাপেনিংস ইন ক্যালকাটা’-র মতো তথ্যচিত্র। অন্যতম নির্মাতা ছিলেন স্বয়ং নৃপেনবাবু। কিন্তু গঙ্গাসাগর মেলার ওপর তাঁরই নির্মিত একটি চলচ্চিত্রকে আটকে দেয় সেন্সর বোর্ড। কেননা, সেই ছবিতে ধরা পড়েছিল নাগা সন্ন্যাসীদের নানান আপত্তিকর কার্যকলাপ। পরবর্তীতে চলচ্চিত্রের স্বার্থে ‘তালনবমী’-র গল্পে সামান্য বদলেও জন্যও কোপ পড়েছিল তাঁর কাজে।
কিন্তু এত কিছুর পরেও ইন্ডাস্ট্রির থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়। বরং, ক্রমশ সমৃদ্ধ করেছেন টলিপাড়াকে। সিনেমার পাশাপাশি কাজ করেছেন ‘মনে রেখো মোর গান’-এর মতো জনপ্রিয় ধারাবাহিক। পরিচালনা করেছেন ‘নয়নছাতি’, ‘মেজদিদি’, ‘অন্তর্জলি’-র মতো টেলিফিল্ম। অভিভাবক ছাতার মতো দাঁড়িয়েছেন তরুণ পরিচালকদের পাশেও। শেষ বয়সেও অনুসন্ধান চালিয়ে গিয়েছিলেন তরুণ পরিচালকদের ভালো কাজের। প্রান্তিক অঞ্চলে পর্দা খাঁটিয়ে সাধারণের কাছে তরুণ শিল্পীদের ভালো কাজ পৌঁছে দেওয়া যায়, এমনটাই বিশ্বাস ছিল তাঁর। নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে সেই ছাতাটাই সরে গেল তরুণ শিল্পীদের মাথা থেকে। বাংলা চলচ্চিত্রজগৎ হারাল তার অন্যতম প্রবীণ অভিভাবককে…
তথ্যঋণঃ
১. চৌরঙ্গী পত্রিকা, নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায় সংখ্যা
২. সোহম দাস
Powered by Froala Editor