১৯৬০-৬১। তখন ভারতের নিজস্ব ডাইনোসর ফসিল আবিষ্কারের সাফল্যের একটা গরিমা ছিল। সেই প্রজাতির ডাইনোসরের নাম দেওয়া হয়েছিল Barapasaurus tagorei। 'Barapa' মানে 'বড় পা'। আবিষ্কৃত জীবাশ্মের একটি ফিমারের (পায়ের হাড়) দৈর্ঘ্য ছিল ১.৭ মিটার। এই জীবাশ্মটির পুনর্গঠন করে আন্দাজ করে হয়েছিল এই বিশেষ ডাইনোসরটির দৈর্ঘ্য আনুমানিক ১৪ মিটার।
১৯৬১ সালটি ছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ। তাঁর প্রতি এই বিজ্ঞানের এই আবিষ্কারকে উৎসর্গ করে স্পেসিফিক নাম রাখা হল tagorei। জুরাসিক যুগের একদম শুরুর দিকের অধিবাসী ছিল এই সরোপড ডাইনোসর। সরোপড কারা? যাদের এই বিশেষ চেহারাগত বৈশিষ্ট্যগুলো থাকে - লম্বা গলা, লম্বা ল্যাজ, তুলনামূলক ছোট মাথা, চারটে মোটা মোটা স্তম্ভের মত পা। অথচ চেহারার গঠনে পরবর্তী সময়ের উন্নত সরোপডদের বৈশিষ্ট্য ছিল। মানে বিবর্তনের দিক থেকে উন্নত প্রজাতি। এই মধ্য জুরাসিক বা শেষের দিকের সরোপডরা এক একটা দানবের মত হত। তাদের তুলনায় Barapasaurus ছোটই বলা যায়।
আরও পড়ুন
কুড়ি রানে ৭ উইকেট নিয়েছিলেন বিবেকানন্দ, বাংলার ‘ডব্লিউ জি গ্রেস’ বলা হত উপেন্দ্রকিশোরের দাদাকে
প্রায় ৩০০-র বেশি অস্থি-জীবাশ্মের সন্ধান পাওয়া গেছিল। অনেক পরে (২০১০-এ প্রকাশিত গবেষণা পত্রে), গবেষকরা জানিয়েছিলেন বন্যার মতো কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হতে হয়েছিল এই হতভাগ্য Barapasaurus-কে। কয়েকটি দাঁত পাওয়া গেলেও খুলিটি পাওয়া যায়নি... সম্ভবত পচতে পচতে আলগা হয়ে জলের স্রোতে ভেসে গিয়েছিল কিংবা অন্য কোনও মৃতজীবী প্রাণীর খাদ্য হয়ে গেছিল। আসলে শরীরের তুলনায় ছোট হত এদের মাথা, অন্য অংশের হাড়ের তুলনায় সেই হাড়ও একটু নরম হত। Barapasaurus-এর করোটি পরে পুনর্নির্মাণ করা হয়, কেমন হতে পারে সেই গবেষণার ওপর ভিত্তি করে।
এই Barapasaurus tagorei-র নামের সঙ্গেই শুধু বাঙালির নাম জড়িয়ে নেই, সেই নিয়ে গবেষণা এবং তার গবেষণা পত্র প্রকাশের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে বাঙালির গৌরব। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত প্রথম গবেষণা পত্রটি যাঁদের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়, তাঁদের মধ্যে দু'জন মুখ্য অবদানকারী ছিলেন বাঙালি - তপন রায়চৌধুরী এবং শংকর চট্টোপাধ্যায়। এমনকি ১৯৫৮ সালে ভারতে যে জীবাশ্মের খোঁজ শুরু হয় সেখানেও প্রশান্তচন্দ্র মহালানবিশের একটি ভূমিকা আছে। শোনা যায়, ১৯৫৮ সালে প্রশান্তচন্দ্র মহালানবিশের সঙ্গে বিশিষ্ট জীবাশ্ম-বিশেষজ্ঞ পামেলা রবিনসনের সাক্ষাৎ হয়। পামেলা রবিনসন স্থির করেছিলেন প্রাচ্যের প্রাচীন সভ্যতার ভূমি চিনদেশে পাড়ি দেবেন জীবাশ্মের খোঁজে। কিন্তু প্রশান্তচন্দ্র তাঁকে বোঝালেন ভারতে এসে কাজ করতে। পামেলাকে সাহায্য করার জন্য আহ্বান জানালেন গণিতজ্ঞ টি এস কুট্টি, প্রাণীবিজ্ঞানী এস এল জৈন এবং ভূবিজ্ঞানী তপন রায়চৌধুরীকে। দক্ষিণ ভারতের অধুনা তেলাঙ্গানা রাজ্যের বিভিন্ন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে গিয়ে স্পেসিমেন সংগ্রহের সেই পরিশ্রমও কোনও অভিযানের থেকে কম ছিল না। বিদেশি অনেক অভিযানের তথ্যচিত্র আমরা টিভির পর্দায় দেখি, অথচ সেই সময় সীমিত প্রযুক্তি এবং নানারকম তৃতীয় বিশ্বের প্রতিকূলতার মাঝে ভারতের প্রথম ডাইনোসর জীবাশ্ম উদ্ধারের সাফল্য-কাহিনি নিয়ে তেমন কিছু চোখে পড়ে না।
১৯৭৫ সালে যে বিশেষজ্ঞদের ইউনিট ‘The Sauropod Dinosaur from the Lower Jurassic Kota Formation of India’ নামে গবেষণা পত্রটি প্রকাশ করেছিলেন, সেই দলেরই জীবাশ্ম-বিশেষজ্ঞ ডঃ শংকর চট্টোপাধ্যায়। আবার বাঙালির নাম জুড়ে দিয়েছিলেন ডাইনোসর আবিষ্কারের সঙ্গে।
আরও পড়ুন
১০০ বছরের মাইলস্টোন ছুঁয়েছেন যেসব কিংবদন্তি বাঙালি
এবারের ঘটনা ৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে, বিদেশের মাটিতে শংকর বাবু উদ্ধার করলেন আবার এক নতুন প্রজাতির ডাইনোসর... চমৎকার তার শারীরিক বৈশিষ্ট্য, নাম দিলেন শুভসরাস - Shuvosaurus। সেই প্রজাতি ছিল ডাইনোসর জগতের মিসিং লিঙ্ক, তার মতো আগে কিছু পাওয়া যায়নি। ডাইনোনিকাসের কাছাকাছি মাপের হলেও এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট আলাদা। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের উদ্যোগে প্রকাশ পেল - ‘Shuvosaurus, a new theropod: an unusual theropod dinosaur from the Triassic of Texas’।
শুভ শংকরবাবুর ছেলের নাম। ছেলে শুভই নাকি খননের স্থানে বাবাকে বিরক্ত করছিল, একটি বিশেষ জায়গার প্লাস্টার খুঁড়ে দেখতে, যদি নতুন কিছু পাওয়া যায়। বিরক্ত হয়ে শংকর বাবু একসময় দেখেন এবং সত্যিই বেরিয়ে আসে জীবাশ্মের অংশ। ১৯৯৩ সালে প্রাথমিক গবেষণার ফল প্রকাশে এল - Shuvosaurus inexpectatus (inexpectatus - অপ্রত্যাশিত), বিশ্বের প্রথম অস্ট্রিচ-গোত্রীয় ডাইনোসর। মানে ডাইনোসরদের মধ্যে সেই প্রজাতি... যার দাঁত নেই, পাখির দৈহিক-গঠনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, মুখের সামনের দিকের হাড়ের গঠন ঠোঁটের মত। শুভসরাস হল মাঝারি থেকে ছোট মাপের থেরোপড গোত্রীয় ট্রায়াসিক যুগের বাসিন্দা (৩ মিটার দৈর্ঘ্য)। থেরোপড কারা? যাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য থেকে অনুমান করা যায় যে তারা মাংসাশী। ধারালো নখ, ধারালো পা এবং তিনটি আঙুল বিশিষ্ট।
পরবর্তীকালে একদল গবেষক বলেন শুভসরাস আলাদা কোনও প্রজাতি নয়, ইতিমধ্যে আবিষ্কার হয়ে গেছে এমন প্রজাতির ভায়রাভাই। কেউ কেউ বলেন পাখি-গোষ্ঠীর কেউ নয়... কিছু ভুল হচ্ছে। ২০০৬-এর কাছাকাছি আর একদল বললেন - কুমিরের কাছাকাছি, কিন্তু পাখির হাবভাবও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তবে যাই হোক, বাঙালির নাম জুড়ে থাকা আরও একটা প্রজাতির ডাইনোসর এখনও থেকে গেছে, অগ্রাহ্য করার উপায় নেই। এখনও অনেকের কৌতূহলের বিষয় taxon Chatterjeea-র অন্তর্ভুক্ত এই Shuvosaurus inexpectatus। বরং ওই যে বলা হয়েছিল 'একাধিক প্রজাতির একটি' বা 'উপস্থির প্রজাতির সমগোত্রীয়'... সেই গবেষণা এনে দিল এক নতুন নাম - Shuvosauridae পরিবার, Shuvosaurus-এর মতো ডাইনোসর প্রজাতিরা যে পরিবারের অংশ।
সুতরাং বুঝতেই পারছেন, বাঙালির সঙ্গে ডাইনোসরের সম্পর্ক শুধু বড়পাসোরাসেই থেমে নেই... তারপরেও থেকে গেছে।
আর ডঃ শংকর চট্টোপাধ্যায়ের মত কৃতী জীবাশ্ম বিশেষজ্ঞ কি বাঙালির জন্য কম গর্বের? তাঁর পাঁচ দশক ধরে করা স্মরণীয় গবেষণা, অবদান এবং একের পর এক ডাইনোসরের জীবাশ্ম আর প্রজাতি আবিষ্কারের ঘটনা Paleontology-র জগতে এক উজ্জ্বল অধ্যায়।