বাঙালিকে চিনিয়েছেন তার প্রকৃত ইতিহাস, আজও যোগ্য সম্মান পেলেন না দীনেশচন্দ্র সেন

উনবিংশ শতকের শেষের দিক। বাংলার সাহিত্যজগৎ তখনও রবীন্দ্রছোঁয়া সেভাবে পায়নি। এবং, তখনও বঙ্গভঙ্গ নামের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকায় ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছেন এক তরুণ। ঢাকারই এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মেছিলেন তিনি, বাবা মানিকগঞ্জ আদালতের উকিল। সেই ছোট্ট থেকেই কবিতা, ছন্দ, সাহিত্য নিয়ে প্রবল উৎসাহ। সাত বছর বয়সেই দেবী সরস্বতীকে নিয়ে পয়ারে লিখেছিলেন স্তবমন্ত্র। আর এইসবের পাশাপাশি মন ছিল ইতিহাসে। এমন প্রেক্ষাপট নিয়েই পড়াশোনা শুরু করেছেন তরুণ দীনেশচন্দ্র সেন। কোনদিকে যাবেন? কী করবেন? কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় একদিন মনের খেয়ালে নোটবুকের সাদা পাতা ওলটাচ্ছিলেন। কী মনে হল, কলম নিয়ে খসখস করে লিখে ফেললেন নিজের মনের ইচ্ছে— “বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হইব, যদি না পারি ঐতিহাসিক হইব। যদি কবি হওয়া প্রতিভায় না কুলায়, তবে ঐতিহাসিকের পরিশ্রমলব্ধ প্রতিষ্ঠা হইতে আমায় বঞ্চিত করে, কার সাধ্য?”  

নিজের জীবনের রাস্তাটা যেন এই নোটবুকের পাতাতেই দেখতে পেলেন দীনেশচন্দ্র সেন। সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হয়তো হতে পারেননি; কিন্তু কবিত্বকে বিসর্জনও দেননি কোনদিন। তবে এইসবের বাইরে গিয়েও দীনেশচন্দ্র সেন হয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। ‘ঐতিহাসিক’ হওয়ার দ্বিতীয় পথটি যে খোলাই ছিল। বাংলার লোকায়ত সাহিত্য, পুঁথি নিয়ে যে গবেষণার রাস্তা তিনি দেখিয়ে গিয়েছিলেন সেই সময়, তা আজও বহু গবেষককে প্রেরণা যোগায়। দীনেশচন্দ্রকে যদি ‘বাংলার পুঁথিমানব’ বলা হয়, তাহলে কি খুব অন্যথা হবে? 

১৮৯৬ সাল। মাত্র কয়েক বছর আগেই স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শেষ করে বেরিয়েছেন দীনেশচন্দ্র। এরপরই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে কাজ শুরু করেন। সেই সময়ই তিনি লক্ষ করেন আরও এক গবেষককে। ইনি বাঙালি নন, ইংরেজ— স্যার জর্জ গ্রিয়ার্সন। ছিলেন ইংরেজ প্রশাসনের একজন কর্মচারী। তবে মনে প্রাণে ভালোবেসেছিলেন এই বাংলার সংস্কৃতিকে। পূর্ববঙ্গে কাজের সূত্রে থাকার সময়ই গ্রামে গ্রামে ঘুরে সংগ্রহ করেন ‘মানিকচন্দ্র রাজার গান’। এশিয়াটিক সোসাইটিতে কাজটি প্রকাশ হওয়ার পর তরুণ দীনেশচন্দ্র সেনের নজরে পড়ে। এবং তখন থেকেই গ্রাম বাংলায় ঘুরে ঘুরে পুঁথি সংগ্রহের ব্যাপারে তাঁর উৎসাহের শুরু… 

১৮৯৬-তেই দীনেশচন্দ্রের ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ বইটি প্রকাশ্যে আসে। গ্রামের তথাকথিত পিছিয়ে থাকা নিরক্ষর মানুষদের ভেতরেও যে সাহিত্যের ধারা বয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে বাংলার মূল ধারার সাহিত্যের পরিচয় ঘটান তিনি। বাংলার একটা বড়ো ধারা সামনে চলে এল আমাদের। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রত্যেকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন দীনেশচন্দ্রকে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ভাষায়, এই বইটি ‘ডিসকভারি অফ আওয়ার লিটারারি হেরিটেজ’। 

কিন্তু দীনেশচন্দ্র কি একরকম অমর্যাদার শিকার? স্নাতক পাশ করার পর কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া স্কুলে শিক্ষকতাও করেছিলেন। পরে সেখানকার প্রধান শিক্ষকও হন। কিন্তু মনেপ্রাণে ইচ্ছে ছিল, কলকাতায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন স্কুলে শিক্ষকতা করবেন। সেই ইচ্ছে নিয়ে চলেও গেলেন সেখানে। ভেবেছিলেন, বিদ্যাসাগরের মতো মহান মানুষ তাঁকে ফেরাবেন না। কিন্তু সেই আশা ভেঙে গেল। শোনা যায়, ‘বাঙাল’ বলে ব্যঙ্গও করেছিলেন বিদ্যাসাগর! ভিক্টোরিয়া স্কুলের একজন অনার্স পাশ ‘বাঙাল’ শিক্ষক এখানে কী করে পড়াবেন? দীনেশচন্দ্র ফিরে এসেছিলেন সেদিন। প্রায় একই ব্যবহার পেয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকেও। সাহিত্যসম্রাটের কাছে সাহিত্য নিয়েই একটু আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অজ পাড়াগাঁয়ের এক ‘বাঙাল’ ছেলের সঙ্গে সেসব আলোচনায় যেতেই চাইলেন না তিনি!  

বরং কাছে টেনে নিয়েছিলেন অন্য একজন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা ভাষার ইতিহাস, সাহিত্যের একটা অচেনা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ দিক বাঙালিকে চিনিয়েছেন যিনি, তাঁকে অস্বীকার করা যায় কী করে! আর দীনেশচন্দ্র সেনের নাম আসলে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা’-র কথা আসবে না তা কী হয়! তখন দীনেশচন্দ্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত। ১৯১৩ সালে ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত পত্রিকা ‘সৌরভ’-এর একটি লেখার দিকে চোখ পড়ল তাঁর। লেখাটি একটি প্রবন্ধ, নাম ‘মহিলা কবি চন্দ্রবতী’। লেখকের নাম চন্দ্রকুমার দে। লেখাটি ছোটো হলেও এত সুন্দর আর তথ্যসমৃদ্ধ! দীনেশচন্দ্রের গবেষক মন লেখকের সন্ধানে বের হল। পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানা গেল, লেখক চন্দ্রকুমার অত্যন্ত দরিদ্র এক যুবক। কিন্তু এখন মাথার ব্যামো হয়েছে; তাই সকল কাজকর্ম বন্ধ… 

আরও পড়ুন
স্বল্পমূল্যে একের পর এক চিরায়ত সাহিত্য; বইপাড়ার ‘ডার্ক হর্স’ রিফ্লেক্ট পাবলিকেশনের গল্প

এ যে তীরে এসে তরী ডোবা! দীনেশচন্দ্র তবুও হাল ছাড়লেন না। ময়মনসিংহে গিয়ে গ্রামে গঞ্জে ঘুরে বেড়ালেন তিনি। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে সংগ্রহ করলেন একের পর এক পুঁথি। আর ভাগ্যদেবতা এমন মানুষের ওপর প্রসন্ন হবেন না, তা কি হয়! চন্দ্রকুমারও একটু একটু করে সুস্থ হচ্ছিলেন। দীনেশচন্দ্র নিজের উদ্যোগেই কলকাতায় নিয়ে গেলেন তাঁকে। শেষ পর্যন্ত দুজনে মিলে নেমে পড়লেন ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ সংগ্রহের কাজে। এ এক দীর্ঘ সাধনা। যার ফল, ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হল— ‘মৈমনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গের গীতিকা’। তৈরি হল ইতিহাস… 

বাংলার চিরন্তন পরম্পরার ভেতর যে সর্বধর্মসমন্বয়ের একটা স্রোত বয়ে যাচ্ছে, সেটা এই পুঁথিগুলো উদ্ধার না হলে হয়তো বোঝাও যেত না। প্রাচীন বাংলার এমন সব রত্ন হয়তো সামনেও আসত না। কী হবে ওসব করে? ভাগ্যিস দীনেশচন্দ্র সেন এসেছিলেন এই বাংলায়! ওই পুঁথি রচয়িতারা কি নিপুণতায় তৈরি করেছেন এক একটি পদ। এসব বাংলা সাহিত্যে স্থান পাবে না? জীবন জুড়ে এত সম্মান, ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি পাওয়ার পরও সেই কাজই করে গেছেন তিনি। এমনকি শোনা যায়, মৃত্যুর সময়ও সেই লেখালেখি করতে করতেই মারা গিয়েছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন। হাতে লেগে ছিল কালির দাগ। বিছানায় শুয়েও জসীমউদ্দিনের ‘নকশি কাঁথার মাঠ’-এর প্রুফ দেখে দিয়েছেন। এ হেন মানুষকে কি মনে রেখেছ বাঙালি? দীনেশচন্দ্র সেনের ধারা বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরই নাতি, কবি সমর সেন। আর বাকি বাঙালিরা? যিনি আমাদের পরিচয়কে সামনে নিয়ে এলেন, তিনি কি একেবারেই পিছনে থেকে যাবেন? 

তথ্যসূত্র-
১) ‘ড. দীনেশ চন্দ্র সেন’, মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী, সাহস
২) ‘বাঙাল দীনেশচন্দ্র সেনের কৃতি ও নীতি’, যতীন সরকার, কালের কণ্ঠ
৩) ‘কলকাতার কড়চা: ফিরে দেখা: আচার্য দীনেশচন্দ্র’, আনন্দবাজার পত্রিকা

আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র-বিভূতিভূষণ থেকে সন্দীপন, বাংলা সাহিত্য মহামারীর সাক্ষী থেকেছে বরাবরই

Powered by Froala Editor

More From Author See More