‘বিশ বছরের বালক দীনেশ ফাঁসি-কাষ্ঠে প্রাণ দিল। কৌতূহলী বালক যেমন নূতন
খেলনা ব্যগ্র বাহু বাড়াইয়া গ্রহণ করিতে লালায়িত হয়, অসীম রহস্যময় মৃত্যুর সহিত মুখোমুখি
দাঁড়াইতে তাহার তেমনি সাধ হইয়াছিল।’
দীনেশ গুপ্তের ফাঁসির পর, আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় কলমে বেরিয়েছিল এই লেখাটি। দীনেশ গুপ্ত, চিনতে পারছেন নিশ্চয়ই! বিনয়-বাদল দীনেশের একজন, রাইটার্সের বিখ্যাত ‘অলিন্দ যুদ্ধে’র সঙ্গে জড়িয়ে যাঁর নাম।
৮ ডিসেম্বর, ১৯৩০। তখন যুদ্ধ চলছে পুরোদমে। কারা বিভাগের কর্তা সিম্পসন সাহেব নিহত হয়েছেন আগেই। আহত আরও কয়েকজন ব্রিটিশ অফিসার। ফোন পেয়ে, লালবাজার থেকে চলে এসেছে গোর্খা সেনাবাহিনী। তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের সঙ্গে বীরদর্পে লড়ছে তিন তরুণ বাঙালি। দেখতে দেখতে রিভালভারের গুলি ফুরিয়ে এল তিনজনেরই। বাদলের কাছে একটাও গুলি নেই আর। বিনয় ও দীনেশের কাছে রয়েছে একটি করে গুলি। প্রাণ যায় যাক, ব্রিটিশের হাতে ধরা দেবেন না কিছুতেই। তিনজনেই খেলেন পটাশিয়াম সায়ানাইডের পুরিয়া। আর, নিজেদের কপালে রিভালভার ঠেকিয়ে অবশিষ্ট দুটি গুলি চালিয়ে দিলেন বিনয় ও দীনেশ।
পুলিশ যখন গ্রেপ্তার করতে এল, বাদল ততক্ষণে মৃত। বিষের প্রতিক্রিয়াতেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর। বিনয় ও দীনেশ আহত। বিষ খাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই গুলি চালানোয়, পাকস্থলী অব্দি পৌঁছোতে পারেনি বিষ।
বিনয় মারা গেলেন দিন পাঁচেক পরে। আর দীনেশ? ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন তিনি। নিজের মাথায় যে গুলি করেছিলেন, সেটা গেঁথে রইল খুলিতেই। মেডিকেল কলেজ থেকে দীনেশকে স্থানান্তরিত করা হল আলিপুর জেলের কনডেমন্ড সেলে। তারপর, স্পেশাল ট্রাইবুন্যালের বিচারে, ফাঁসির আদেশ হল তাঁর।
দীনেশের অবশ্য বিশেষ হেলদোল নেই তাতে। নির্জন সেলের ভেতরে পড়াশুনা করেই কাটছে দিন। রবীন্দ্রনাথের কবিতা আর গীতা হয়ে উঠেছে তাঁর সবসময়ের আশ্রয়। সঙ্গে, লিখলেন বেশ কয়েকটা চিঠিও। ভাই, বৌদি, মা ও আরও কয়েকজনকে। সেই চিঠিগুলো পড়লে আজও বোঝা যায় তাঁর ভাবনার গভীরতা।
১৯৩১ সালের ১৮ জুন, আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বসে বৌদিকে লিখছেন –
‘যে দেশে মানুষকে স্পর্শ করিলে
মানুষের ধর্ম নষ্ট হয়, সে দেশের ধর্ম আজই গঙ্গার জলে বিসর্জন দিয়া নিশ্চিন্ত হওয়া
উচিত। সবার চাইতে বড় ধর্ম মানুষের বিবেক। সেই বিবেককে উপেক্ষা করিয়া আমরা ধর্মের
নামে অধর্মের স্রোতে গা ভাসাইয়া দিয়াছি। একটা তুচ্ছ গরুর জন্য, না হয় একটু ঢাকের
বাদ্য শুনিয়া আমরা ভাই-ভাই খুনোখুনি করিয়া মরিতেছি। এতে কি ভগবান আমাদের জন্য
বৈকুণ্ঠের দ্বার খুলিয়া রাখিবেন, না খোদা বেহেস্তে আমাদিগকে স্থান দিবেন?’
ভাবতে অবাক লাগে, একজন বিপ্লবী, যিনি নির্জন সেলে বন্দি, কিছুদিন বাদেই ফাঁসির দড়িতে জীবন সমাপ্ত হবে যাঁর, ভারতের চিরন্তন ধর্ম-সমস্যা নিয়ে কী অক্লেশেই না ভাবতে পারছেন তিনি! যে বিষয় নিয়ে আজও জর্জরিত গোটা দেশ, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তিনি, ১৯৩১ সালে, একটি নির্জন জেলে বসে!
কয়েকদিন বাদে, মা’কে চিঠি লিখেছেন তিনি। ৬ জুলাই। পরেরদিন তাঁর ফাঁসি। দীনেশ লিখছেন –
‘তোমার সঙ্গে আর দেখা হইবে না।
কিন্তু পরলোকে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করিব। তোমার কিছুই কোনদিন করিতে পারি নাই।
সে না করা যে আমাকে কতখানি দুঃখ দিতেছে তাহা কেহই বুঝিবে না, বুঝাইতে চাইও না।
আমার যত দোষ, যত অপরাধ, দয়া করিয়া ক্ষমা করিও। আমার ভালোবাসা জানিবে।’
পরেরদিন সকাল। মুখে ‘বন্দেমাতরম্’
ধ্বনি। ফাঁসির দড়ি গলায় নিলেন দীনেশ গুপ্ত। শুরুতে আনন্দবাজার পত্রিকার যে
সম্পাদকীয় কলামের কথা উল্লেখ করেছিলাম, তারই আরেকটি অংশ দিয়ে শেষ করা যাক –
‘দীনেশ বাঁচিল না – তাহাকে মৃত্যুর
গ্রাস হইতে রক্ষা করা গেল না। খেদখিন্ন নৈরাশ্যের দীর্ঘশ্বাস একটা জাতির
পঞ্জর-পিঞ্জর কাঁপাইয়া শূন্যে মিলাইয়া গেল। কম্পিত অধরোষ্ঠে কি কথা মৌন রহিয়া গেল,
বোঝা গেল না। কেহ কি বুঝিবে?’
Powered by Froala Editor