১৯১৩ সাল। ময়মনসিংহের ‘সৌরভ’ নামের একটি মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয় মহিলাকবি চন্দ্রাবতীর কাহিনির সারাংশ। সঙ্গে প্রাচীন পল্লিগীতির কয়েকটি ছত্র। প্রবন্ধের লেখক ও সংগ্রাহকের নাম চন্দ্রকুমার দে। কে এই চন্দ্রাবতী? যাঁর পিতা বংশীদাস ছিলেন মঙ্গলকাব্যের অন্যতম রচয়িতা। আর তিনি মধ্যযুগের একমাত্র মহিলাকবি, যিনি রামায়ণ লিখেছিলেন। ষোড়শ শতকে লেখা ‘কেনারামের পালা’ মুখে মুখে ঘুরত গ্রামগঞ্জের মানুষের মুখে। চন্দ্রাবতী আর জয়ানন্দের কাহিনি ছিল প্রেম আর বিরহের চিরকালীন প্রণয়গাথা। দীনেশচন্দ্র সেনের (Dinesh chandra Sen) হাতে যখন ‘সৌরভ’ পত্রিকার প্রবন্ধ এসে পৌঁছোল, তখনও লোকজীবনে ছড়িয়ে থাকা এই গাথাকাব্যগুলি সংকলিত রূপ পায়নি। কেনারামের কাহিনি পড়ে তিনি নির্বাক হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। একইসঙ্গে ঠিক করলেন মৌখিক কাহিনিগুলিকে সংগ্রহ করার।
দীনেশচন্দ্র তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ প্রকাশের পর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস বিষয়ে খুলে দিয়েছেন নতুন দিগন্ত। রামতনু লাহিড়ী ফেলোশিপ পেয়ে লিখেছেন সাতখানি ইংরেজি গ্রন্থ, বিদেশ থেকে নিয়মিত প্রশংসা পাচ্ছেন সেগুলির জন্য। কিন্তু মন পড়ে আছে ‘পুরাতন জিনিষ’ সংগ্রহের প্রতি। রবীন্দ্রনাথকে লিখছেন সেকথা। বারবার মনে হচ্ছে বাংলার প্রান্তরে মানুষের মুখে মুখে যে সজীব কাহিনি ছড়িয়ে আছে, সেগুলিই দেশের সাহিত্যের জাতীয় সম্পদ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত, এমনকি হারিয়ে যেতে পারে তার রূপ। কিংবা কোনো বিদেশি গবেষকের হাতে পড়ে বদলে যেতে পারে মূলভাব। দীর্ঘ পরিশ্রমের ফলে অসুস্থ হয়ে পড়া শরীরেও এই ভাবনায় ব্যাকুল করে তুলছে তাঁকে। আর তখনই এসে পড়ে চন্দ্রকুমার দে-র প্রবন্ধ।
কিন্তু এই ভদ্রলোককে পাবেন কীভাবে? ‘সৌরভ’-এর সম্পাদক কেদারনাথ মজুমদারের পাঠানো বক্তব্য আরো চিন্তাজনক। ময়মনসিংহের বাসিন্দা চন্দ্রকুমার জমিদারের তহশীলদার ছিলেন, সেই সময়ে কাজ ফেলে শুনতেন ক্ষেতের চাষিদের গান। সেগুলিকেই সংগ্রহ করে লিখেছিলেন প্রবন্ধটি। তবে বর্তমানে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ। কাজ করার মতো অবস্থাতে নেই। দীনেশচন্দ্র হতাশ হলেও হাল ছেড়ে দিলেন না, ময়মনসিংহের বহু মানুষের কাছেই সন্ধান করলেন গাথা সাহিত্যের বিষয়ে। কিন্তু সবর্ত্রই ব্যর্থতা। শহুরে শিক্ষিতরাও ‘চাষাভুষো’-র গান আর পুঁথি সংগ্রহ করা নিয়ে ব্যঙ্গ করেছে তাঁকে। শুধু দীনেশচন্দ্র জানেন, কী অমূল্য সম্পদ লুকিয়ে আছে সেই গানে। লোকসুরের সহজ অভিব্যক্তিতে মিশে আছে দার্শনিকতা। ধর্ম-সংস্কারের ঊর্ধ্বে মহান হয়ে উঠেছে সর্বকালীন প্রেম। এভাবেই কি হারিয়ে যাবে বাংলার নদী-ক্ষেতের উপর দিয়ে ভেসে আসা সুরের প্রতিধ্বনি?
দু-বছর পরে খোঁজ মিলল চন্দ্রকুমারের। এখন অনেকটা সুস্থ তিনি। ১৯১৯ সালে প্রায় সর্বস্ব বেচে তিনি এসে পৌঁছোলেন দীনেশচন্দ্রের কাছে। বয়স বড়োজোর তিরিশ, কিন্তু রোগে আর অপুষ্টিতে অনেক বয়স্ক দেখায় তাঁকে। দীনেশচন্দ্র জড়িয়ে ধরলেন অসমবয়সী, অচেনা বন্ধুটিকে। তারপর শুরু হল গল্প শোনা। কাদা মাঠে পা ডুবিয়ে, বট গাছের ছায়ায় বসে কিংবা শালুকঢাকা বিলের ডিঙিতে বসে চন্দ্রশেখর শুনেছেন মানুষের গান। আজ নয়, তিনি যেন কয়েকশো বছরের শ্রোতা। অবশ্য এটাও খেয়াল করেছেন যে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে গীতিকাগুলি। বদল আসছে মানুষের রুচিতে। তাই তিনি নিজের দায়িত্বেই সংগ্রহ করছেন পালাগান।
আরও পড়ুন
ভালো ভূত আর ভালো মানুষের খোঁজে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘অদ্ভুতুড়ে’ সিরিজ
‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’-এর সময়ও তো একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল দীনেশচন্দ্রের। তাই চন্দ্রকুমারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিলেন তিনি। পাশাপাশি সাহায্য চাইলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। বললেন, “আমি আর এক ভাণ্ডারের সন্ধান পেয়েছি যা বৈষ্ণব মহাজনদের পদাবলীর প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়াতে পারে। এই গীতিগুলি উদ্ধার করতেই হবে স্যার।” আশ্বাস দিলেন ‘বাংলার বাঘ’, নিলেন সমস্ত খরচের দায়িত্ব। চন্দ্রকুমারের ঝোঁক তখন পড়েছে পৌরাণিক কাহিনি নিয়ে রচিত সংস্কৃত শব্দবহুল কাব্যগুলির উপর। যেমন মুক্তারামের ‘দুর্গাপুরাণ’, রামুকান্তের ‘মনসা ভাসান’, ‘দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ’ প্রভৃতি। এগুলির সংরক্ষণ অবশ্যই দরকার, কিন্তু মৌলিকতার দিক থেকে পিছিয়ে এই কাব্যসংগ্রহ। প্রয়োজন পল্লিগাথাগুলি উদ্ধার করা। সেই অনুযায়ী চন্দ্রকুমার সংগ্রহ করলেন একুশটি পালাগান। যার প্রত্যেকটির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ময়মনসিংহের ইতিহাসের কোনো সত্য ঘটনা। মানুষের আর্তি, বেদনা, সুখ-দুঃখ, ছোটো ছোটো মুহূর্তরা ভিড় করেছে কল্পকাহিনির আবরণে। আসলে সোচ্চারে বলতে চায় নিজেদের গল্প। নায়ক-নায়িকারাও তথাকথিত শাপভ্রষ্ট দেবতা নয়। বৈশ্য, বেনে, সদগোপ, ডোম সমাজ থেকে তাদের উঠে আসা। হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির আশ্চর্য উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে ছত্রে ছত্রে।
আরও পড়ুন
ফরাসি সাহিত্যচর্চায় পেয়েছিলেন সম্মান, বাঙালির কাছে এক বিস্মৃতপ্রায় নাম লোকনাথ ভট্টাচার্য
দীনেশচন্দ্র ‘মহুয়া’ পালার ইংরেজি অনুবাদ লিখে পাঠিয়ে দিলেন লাটসাহেব লর্ড রোল্যান্ডসের কাছে। মুগ্ধ হলেন তিনি, গ্রন্থের জন্য ভূমিকাও লিখে দিলেন। ইংরেজ সাহেবের এই সাহায্যটুকু প্রয়োজন ছিল সেই শহুরে শিক্ষিতদের জন্য, যারা প্রথম থেকেই অবিশ্বাস করেছিল দীনেশচন্দ্রকে। কিন্তু শুধু তো ময়মনসিংহ নয়, সারা বাংলা জুড়েই এরকম অসংখ্য লোককাব্য ছড়িয়ে আছে। দীনেশচন্দ্র আর চন্দ্রকুমার দুজনের পক্ষে সেগুলি সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। লোকবলের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হল। তবে, স্পষ্টভাবে এড়িয়ে যাওয়া হল ‘উচ্চশিক্ষিত’দের। তার সঙ্গে রইল এক অভিনব প্রস্তাব। চন্দ্রকুমারের মতো কাব্যের নমুনা সংগ্রহ করে পাঠাতে পারলে দেওয়া হবে অগ্রাধিকার। আর সেই অনুযায়ী নির্বাচিত হলেন বিহারীলাল চক্রবর্তী, আশুতোষ চৌধুরী, কবি জসীমউদ্দিন-সহ আরো কয়েকজন। মোট ৩৯টি পালা নিয়ে প্রকাশিত হল ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’। মহুয়া, মলুয়া, জয়চন্দ্র-চন্দ্রাবতী, কংক ও লীলা, ভেলুয়া সুন্দরী, মদিনা, কেনারামের পালা ছিল এই গ্রন্থে। তারপর তিন খণ্ডে প্রকাশিত হয় ‘পূর্ববঙ্গগীতিকা’, ইংরেজিতে ‘ইস্টার্ন বেঙ্গল ব্যালাডস’ (Eastern Bengal Ballads)। ময়মনসিংহ গীতিকা প্রকাশের পর যখন তুলে দেওয়া হল আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের হাতে, তখন তার গুরুগম্ভীর মুখে ভারি গোঁফের তলা দিয়ে ফুটে উঠল হাসি, চোখে দেখা গেল গর্বের ছায়া। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এল শুভেচ্ছাবার্তা।
অবশ্য পরে অভিযোগ উঠেছিল যে চন্দ্রকুমার দে পালাগুলির বিশুদ্ধ রূপটি নিজের মতো বদলে দিতেন। এমনকি নিজের লেখা কবিতাও প্রচার করেছিলেন প্রাচীন গাথা বলে। আবেগের বশে এই চাতুরি ধরতে পারেননি দীনেশচন্দ্র। কিছুটা অসতর্কতা থেকে গেলেও এ অভিযোগ সম্পূর্ণ সত্য নয়। লোকসাহিত্যের বিচিত্র রূপ আর বিচিত্র প্রকাশকে সংকলিত করতে সচেষ্ট ছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন। মৌখিক গাথা হয়ে উঠেছিল সর্বজনীন। বাংলার ইতিহাসের এক আশ্চর্য মেলবন্ধন ঘটেছিল তাঁর সংগ্রহে।
ঋণস্বীকার : স্মৃতি বিস্মৃতিতে দীনেশচন্দ্র সেন, সুদেষ্ণা চক্রবর্তী
Powered by Froala Editor