সিদ্ধান্তটা বেশ কয়েক দিনের পুরনো। তবু তা নিয়ে বিতর্কের রেশ যেন থামছেই না। সংস্থার মহিলা কর্মীদের জন্য বছরে ১০ দিনের ‘পিরিয়ড লিভ’ বা ‘ঋতুকালীন ছুটি’ চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জোম্যাটো। ভারতের বৃহত্তম খাবার সরবরাহ সংস্থা জানিয়েছিল, ঋতুস্রাবের সময় মহিলাদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা বিবেচনা করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থা। ঋতুস্রাবকে ‘ট্যাবু’ বিবেচনা করার যে ধারা চলে এসেছে দীর্ঘকাল ধরে, তাকে ভাঙ্গার জন্য এমন একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল বলে সংস্থার দাবি।
উদ্দেশ্য যাই থাক না কেন, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক এবং পাল্টা বিতর্ক শুরু হয়েছে নানা মহলে। একথা সত্যি যে, পিরিয়ডস মানেই একটি তীব্র যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা অনেক মেয়েদের কাছেই। সেইসঙ্গে লেগেই থাকে পিরিয়ডস জনিত কারণে অন্যান্য নানা শারীরিক অসুবিধা এবং সেই কারণে খেতে হওয়া বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। তবুও যন্ত্রণা সহ্য করেই অফিস-কাছারি সামলাতে হয় মহিলাদের। তাই জোম্যাটো সংস্থার দাবি সিক লিভের পাশাপাশি সারা বছরে এই অতিরিক্ত দশ দিনের ছুটি মঞ্জুর করা প্রয়োজন ছিল সংস্থার মহিলা কর্মীদের জন্য। রূপান্তরিত মহিলা কর্মীদের জন্য এই একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে।
এর আগে ২০১৭ সালে কংগ্রেসের লোকসভার সাংসদ নিনং এরিং 'মাসিক ঋতুকালীন উপকারিতা বিল, ২০১৭' আনার কথা বলেছিলেন। বিলের আওতায় কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের আওতায় নিবন্ধিত সরকারী ও বেসরকারী উভয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মহিলাদেরকে ঋতুস্রাব চলাকালীন প্রতি মাসে দু'দিনের ছুটি মঞ্জুর করার কথা বলা হয়েছিল। অর্থাৎ বছরে মোট ২৪ দিন। এছাড়াও প্রায় ৩০ বছর আগে বিহারের লালু প্রসাদ সরকার শ্রমজীবী মহিলাদের জন্য মাসিক চলাকালীন ছুটির প্রবর্তন করেছিল, যা অবশ্যম্ভাবীভাবে এগিয়ে ছিল সময়ের থেকে। স্বাভাবিক ভাবেই জোম্যাটোর এই সিদ্ধান্ত তাই একদম নতুন কিছু নয়।
কিন্তু এর সুবিধাজনক দিকগুলির পাশাপাশি প্রশ্ন উঠছে আরও কয়েকটি বিষয় নিয়ে। এর ফলে আদৌ মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে সুবিধা হবে, নাকি এটা আসলে ঘুরিয়ে তাদের দুর্বল প্রমাণ করার প্রচেষ্টা, সেই নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। খুব সাধারণভাবেই কর্মক্ষেত্রে দেখা যায়, পাশের কোনও সহকর্মী যদি বাড়তি কিছু সুবিধা পেয়ে থাকেন, তাহলে চোখ টাটায় অনেকেরই। তাই এক্ষেত্রে মাসে একদিন অথবা বছরে দশ দিন বাড়তি ছুটি যে কিছু ক্ষেত্রে মেয়েদের প্রতি বিদ্বেষ বাড়িয়ে তুলবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায় আছে? তার সঙ্গেই যেখানে এখনও সমাজে মেয়েদের ঋতুকালীন সময়ে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, সেখানে এই কারণ দেখিয়ে কোনও মহিলা যদি ছুটি নেন তাহলে তাকে আরও বেশি ‘এক্সপোজ’ অথবা ‘ভালনারেবল’ করে দেওয়া হবে না কি? ভারতের মতো দেশে এই সন্দেহ জাগা কিন্তু অত্যন্ত স্বাভাবিক।
যদি তলিয়ে দেখা যায়, তাহলে আরও একটা সমস্যার কথা কিন্তু উঠে আসে। মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণার বশবর্তী হয়ে এখনও অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, শারীরিকভাবে পুরুষেরা মহিলাদের থেকে শক্তিশালী হওয়ায় কর্মক্ষেত্রেও তারা অনেক বেশি যোগ্য। এছাড়াও, পিতৃতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার বোঝা তো আমরা বয়ে নিয়েই চলেছি আমাদের ভিতরে। এখনও কর্মক্ষেত্রে মাথার উপর মহিলা কর্মচারীকে গ্রহণ করতে বাঁধে অনেক পুরুষেরই। এছাড়াও ছুটি মঞ্জুর করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্থার অনীহা নতুন কিছু নয়। তাই সেখানে মহিলাদের বাড়তি ছুটি দিতে হবে ভেবে মহিলা কর্মী নিয়োগে সংস্থারা উৎসাহ যে হারিয়ে ফেলবেন না, তাতেই বা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে কোথায়? এছাড়াও উঠে আসছে আরও কিছু মৌলিক জায়গা। ছুটির থেকেও কর্মক্ষেত্রে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শৌচাগার, পরিষ্কার জল এবং স্যানিটারি ন্যাপকিনের পর্যাপ্ত যোগান থাকছে কিনা, সেই ব্যাপারটা মাথায় রাখা দরকার কিন্তু আরে অনেক বেশি।
তবে ঋতুকালীন সময়ে ছুটি বিরোধিতা যারা করেছেন তার বিপক্ষেও কিছু যুক্তি কিন্তু অবশ্যই ভেবে দেখা দরকার। যেমন অনেকেই বলছেন, ঋতুকালীন সময়ে বাড়তি ছুটির কি দরকার? সিক লিভ থেকেই তো সেটা নিয়ে নেওয়া যেত। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, পিরিয়ডসকে কি সত্যিই অসুস্থতা বলে মনে করেন অনেকে? যদি অসুস্থতার জন্য ধার্য ছুটি পিরিয়ডের কারণেই শেষ হয়ে যায়, তাহলে সত্যি সত্যি অন্য কোনও কারণে অসুস্থ হলে তখন তার জন্য ছুটি কোথা থেকে পাওয়া যাবে?
আরও পড়ুন
১৪ মাসে আত্মহত্যা ১৩ কর্মীর, ছাঁটাইয়ের পথে আরও ২০ হাজার; খাদের কিনারায় বিএসএনএল?
তবে এর সঙ্গে অবশ্যই থাকছ ছুটি ব্যবহারের ব্যাপারে সততার বিষয়টিও। এই পিরিয়ড লিভ-এর সুবিধাকে অনৈতিকভাবে ব্যবহার করবেন না মহিলারা, সেটাই কাম্য। কারণ খারাপ উদাহরণ একবার তৈরি হয়ে গেলে তার প্রভাব কিন্তু পড়তে পারে অন্যান্য মহিলা কর্মীদের উপরেও।
যদিও এই সকল আলোচনা থেকে বাদ পড়ে থাকছে একটা বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। সেটা হল অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত মহিলারা। মাঠে, ইটভাটায়, মাটি কাটার কাজে অথবা অন্যান্য ক্ষেত্রে শ্রমিকের কাজ করেন যেসব মহিলারা, তাদের কোনও প্রসঙ্গে কিন্তু এক্ষেত্রে ওঠেনি। ওঠেনি বাড়ির কাজের মহিলাদের কথাও। নামমাত্র মূল্যের বিনিময়ে কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করেন যারা, পিরিয়ডস-এর মতো শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাদের জন্য কী ধরনের সমস্যা তৈরি করতে পারে তা সহজেই বোধগম্য। অথচ ঋতুকালীন সময়ে নিতান্ত সাধারণ সুযোগ-সুবিধা টুকুও পেয়ে ওঠেন না তাঁরা। ঋতুকালীন সময়ে মহিলাদের জন্য একান্ত প্রয়োজন একটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শৌচালয়। কিন্তু এই সাধারণ সুবিধাটুকু না থাকার জন্যই ভারতে প্রতিবছর পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় লক্ষ লক্ষ মেয়েরা।
তাই জোম্যাটো সংস্থার এই সিদ্ধান্তের ভালো দিকগুলি মাথায় রেখেও বলতে হয়, প্রাথমিক জায়গাগুলিতে নজর না দিলে কিন্তু দূর করা যাবে না ঋতুকালীন সময়ের এই সমস্যা। অন্যান্য সংস্থারও দায়িত্ব নেওয়া উচিত যে, কোনোভাবেই এই ধরণের সিদ্ধান্ত যেন কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের প্রতি বিরূপ মনোভাব তৈরি না করে। এবং অবশ্যই অসংগঠিত ক্ষেত্রে মহিলা কর্মীদের জন্য এই ধরনের কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে, তার থেকে ভাল আর কিছু হয় না বোধহয়। সেই আলোর দিনের আশা দেখতে ক্ষতি কী!
আরও পড়ুন
১৮ থেকে বেড়ে ২১, বিবাহের আইনি বয়স বাড়িয়েও কি রোখা যাবে প্রসবকালীন মৃত্যু?
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor