চুলের বাহার বা চুলের স্টাইল নিয়ে সেই কবে থেকেই কবি-সাহিত্যিকরা লিখেছেন তাঁদের মুগ্ধতা। বিশেষ করে নারীর কেশদামের প্রশস্তি খোলামনে প্রকাশ করেছেন বারবার। রবীন্দ্রনাথের সাগরিকার ‘সজল এলোচুল’ই হোক বা জীবনানন্দের বনলতা সেনের ‘অন্ধকার বিদিশার নিশা’র উপমা, কবির সেই বর্ণনাতেই নারীরা হয়ে উঠতেন মোহময়ী। পাশাপাশি, পুরুষের চুলের বাহারও কাব্য-চিত্রকলায় উপেক্ষিত হয়নি কিন্তু। পুরুষের চুলের টেরি আর নারীর ঘন কেশগুচ্ছ পটুয়াদের পটেও হয়ে উঠেছে জীবন্ত।
কিন্তু এই চুলের স্টাইল যুগের সঙ্গে-সঙ্গে কেমন পাল্টেছে, তা নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয় না। অথচ আদিকাল থেকেই বিভিন্ন নিদর্শন আমাদের সামনেই উপস্থিত। হরপ্পা সভ্যতা থেকে ভারতীয় মধ্যযুগ পর্যন্ত কেশবিন্যাসের ধারা কীভাবে বদলেছে, তারই বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের সুবাদে।
হরপ্পা সভ্যতা থেকে ভারতের মধ্য যুগ পর্যন্ত সময়ের কেশ বিন্যাসের পরিবর্তনের ধারাকে তিনটি যুগে ভাগ করা যায়, যার প্রথম ভাগটি হল হরপ্পা সভ্যতা থেকে কুষাণ যুগ পর্যন্ত।
হরপ্পা সভ্যতার রাখিগাঢ়ি, মহেঞ্জোদাড়ো, ঢোলাবেড়িয়া, কালিবঙ্গান, বনওয়ালি প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষদের ভিন্ন ভিন্ন চুলের স্টাইলের প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় প্রত্নতাত্বিক খননের ফলে। পাশাপাশি, চিরুনি ও আয়নার ব্যবহারেরও উদাহরণ রয়েছে যথেষ্টই। একটি হ্যান্ডেলের সঙ্গে দুটি ডিম্বাকৃতি তামার আয়নার ব্যবহার রাখিগাঢ়ি ও কালিবঙ্গান অঞ্চল থেকে পাওয়া যায়।
হরপ্পা সভ্যতার নৃত্যরত নারীর সেই বিখ্যাত ভাস্কর্য ভারতীয় শিল্পকলার অন্যতম নিদর্শন। নারীটির চুল কাঁধের একপাশে পাট করে নিয়ে তার থেকে দু’গাছি চুল আলাদা ভাবে ভাগ করে ক্রিসক্রস স্টাইলে বিনুনির মতো করে ডান কাঁধ অবধি বিস্তৃত। আবার মহেঞ্জোদাড়োর পুরোহিতের পরিধানে বিস্তৃত কারুকার্য করা পোশাক ও অলঙ্করণ। তার দাড়ি পরিপাটি করে ছাঁটা ও চুলের মধ্যভাগে সিঁথি, কপালে বাঁধা ফেট্টি অর্থাৎ এখনকার হেয়ার ব্যান্ড। মহিলাদের খোঁপা করার যে রীতি ও ধরণ, তার গোড়ায় রয়েছে চিরুনির ইতিকথা। হাতির দাঁতের তৈরি চিরুনি পাওয়া গিয়েছে বনওয়ালি, কালিবঙ্গান, হরিয়ানার উত্তরাঞ্চল, রাজস্থানের নানা জায়গায়। এ-থেকে স্পষ্ট যে, চুলের বিশেষ যত্ন নেওয়াতে মহিলা বা পুরুষ কেউই সেই যুগে পিছপা ছিলেন না।
এবার আসা যাক মৌর্য যুগের ভাস্কর্যের বিবরণীতে। মৌর্য যুগের পাথর ও পোড়ামাটির শিল্পকর্মে মহিলাদের কেশ বিন্যাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। চাণক্যের অর্থশাস্ত্রে মহিলাদের দু’ধরণের কেশ বিন্যাসের উল্লেখ আছে। দিদারগঞ্জ যক্ষীর ভাস্কর্যে দেখা যায়, পরিপাটি ভাবে আঁচড়ানো চুল সুন্দর ভাবে মাথার পেছনে বাঁধা। চুলের মাঝখান থেকে এক গাছি চুল নিয়ে তৈরি বিনুনির সঙ্গে রয়েছে কপাল থেকে বিস্তৃত টিকলি। এসবই পরিচয় দেয় সেকালের রুচির উৎকৃষ্টতার।
শুঙ্গ যুগের ভাস্কর্যের বিশেষত্ব ছিল সরলতা। সাঁচি স্তুপের সালাভঞ্জিকার ভাস্কর্যটিতে চুলের অসাধারণ বিস্তৃত বিন্যাস রয়েছে। তার মাথার উপরের একগাছি চুল নিয়ে ঝুঁটির আকারে বাঁধা, এবং বিস্তৃত এলোচুল পিঠ পর্যন্ত বিস্তৃত। ভারহুত স্তুপের ভাস্কর্যে বোধিগাছের পুজোয় রত মহিলাদের অদ্ভুত সুন্দর চুলের বিন্যাস লক্ষ্য করা যায়। তাদের চুল পরিপাটি ভাবে আঁচড়ানো, মাথার উপরের চুল চূড়া করে এবং পিঠ পর্যন্ত বিস্তৃত চুল নিচের দিকে সুন্দর গিঁট দিয়ে বাঁধা। ভারহুত শিল্প কর্মের অপর একটি প্যানেলে দেখা যায় একাধিক সংগীতজ্ঞ, যেখানে তাদের চুল কপাল থেকে কাঁধ অব্দি বৃত্তাকার দুই ধাপ বিনুনি করে বাঁধা।
সাতবাহন সাম্রাজ্যের অমরাবতী ও নাগার্জুনকোন্ডা থেকে যে-সমস্ত স্থাপত্যগুলি পাওয়া গিয়েছে, তা থেকে স্পষ্ট হয় যে, সেকালের পুরুষদের চুল ছোট করে কাটা ছিল, তাদের কোঁকড়ানো চুল ও বিলি পৌরুষের পরিচয় দিত। পরচুলার ব্যবহারও সে যুগ থেকেই। মহিলাদের চুল একাধিক লুপের মাধ্যমে চূড়ার মত করে বাঁধা থাকত। পিতলখোড়ার বামন-যক্ষের একটি ভাস্কর্যে লক্ষ্য করা যায়, তার ঘন কোঁকড়ানো চুল কপাল অব্দি বিস্তৃত।
কুষাণ যুগে মথুরা এবং গান্ধার রীতির মতো ভাস্কর্য শিল্পকলা উত্তর পশ্চিম ভারতে বিস্তার লাভ করেছিল ব্যাপকভাবে। যেগুলি অনেকটাই গ্রিক শিল্পকলার আদর্শে নির্মিত। ব্রোঞ্জের ব্যবহারও গ্রিক ভাস্কর্যের মতোই। ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি একটি শিশুর মাথা গান্ধার শিল্পের এক অনন্য উদাহরণ। এখনকার মতো ডাকটেল পদ্ধতিতে পরিপাটি ভাবে মাথার পেছনে আঁচড়ানো তার চুল, যা বর্তমানে চুলের জেল এবং স্প্রের ব্যবহারে করা হয়ে থাকে। গ্রিক শিল্পকলার আকারে নির্মিত বোধিসত্ত্বের ভাস্কর্যটিতে দেখা যায়, তার মুখে শোভা পাচ্ছে পুরু একটি গোঁফ এবং তার বিস্তৃত চুলগুলি মাথার ওপরে বাঁদিকে পাট করে গিঁট বাঁধা হয়েছে। চুলের স্তরগুলি আলাদা ভাবে চিহ্নিত করতে পুঁতির মালা পরানো, যা বর্তমান হেয়ার ব্যান্ডের ব্যবহার এবং পনিটেলের চিন্তা ভাবনার ভিত বলে মনে করা হয়।
খ্রিস্টিয় যুগের শুরু থেকে প্রায় সপ্তম শতাব্দী অবধি মথুরা উত্তর ভারতে এক সমৃদ্ধ শিল্পকেন্দ্র ছিল। দেব-দেবী ছাড়াও লোকশিল্প ছিল শিল্পকলার অন্যতম প্রধান উপাদান। মথুরা স্কুল অফ আর্টের এমনি এক প্যানেলে একটি মহিলার দৃশ্য দেখা যায়, যিনি স্নানের পর সিক্ত চুলগুলি খুলে রেখেছেন এবং তা থেকে জল ঝরে পড়ছে। মথুরা শিল্পের পোড়ামাটির ভাস্কর্যের আরেকটি শিল্পে দেখা যায়, চুলগুলি পেছন দিকে ঘাড় অব্দি বিস্তৃত এবং চুলের শেষ অংশ একটি বাঁক তৈরি করে শেষ হয়েছে। বর্তমান যুগে যাকে 'বব কাট' হেয়ার স্টাইল বলা হয়। এই 'বব কাট' নারীদের ক্ষেত্রে অতি পরিচিত একটি হেয়ার স্টাইল। মথুরার আরো একটি ভাস্কর্যে দেখা যায় একটি মহিলা অশোকগাছের ডাল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, যার দৈহিক কার্ভগুলি অসাধারণ ভাবে খোদাই করা হয়েছে। তার চুল বর্তমান 'হেয়ার ডোনাট' পদ্ধতিতে উপরের দিকে একগাছি চুল পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধা হয়েছে। এবং একেবারে উপরের দিকে অপর এক গাছি চুল উন্মুক্ত 'হেয়ার ক্লিপের' সঙ্গে আবদ্ধ। তার কপাল থেকে সুন্দর একটি টিকলি শোভা পাচ্ছে।
আসলে, এ-সবই হল বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা সে-আমলকে। এবং কিছু মিল খুঁজে পেলে, তুলনামূলক আলোচনা। সত্যিই, যেভাবে সভ্যতা উন্নত হল ধাপে ধাপে, সেভাবেই হয়তো হেয়ার স্টাইলের চিন্তাধারাও হরপ্পা, কুষাণ, মৌর্য যুগ থেকে বয়ে এল বর্তমান যুগে। কে বলতে পারে?