বিকেলেও বেড়িয়ে এলেন সুস্থ শরীরে, রাতে হঠাৎ বন্ধ হৃদযন্ত্র; মৃত্যু আগাম টের পেয়েছিলেন বিবেকানন্দ?

সকাল এগারোটা। অন্যান্য দিনের মতোই কাজকর্ম চলছে বেলুড় মঠে। ঠাকুরঘরে ধ্যানে বসেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর তখন শান্ত, স্থিতধী রূপ। ধ্যান ভাঙার পর শুরু করলেন গান। বড়ো ভালো গলা, ঠাকুর কতবার তাঁর প্রিয় নরেনের গান শুনে তন্ময় হয়ে যেতেন! সঙ্গে আছেন স্বামী প্রেমানন্দ ও অন্যান্য কয়েকজন। সকালেই ইলিশ নিয়ে একপ্রস্থ ঠাট্টা হয়ে গেছে, দুপুরবেলা টাটকা টাটকা পদ হাজির। ব্রেন যে ‘উইক’ হচ্ছে, সেটা যেন বুঝতে পারছিলেন স্বামীজি। কিন্তু অযথা বিশ্রাম নেওয়ার মানুষ তো তিনি নন। মিনিটখানেক গড়িয়ে নিয়ে ঢুকে পড়লেন লাইব্রেরি। এখন তাঁর পড়ানোর সময়…

ক্লান্তি কিছুতেই কমছে না। শেষমেশ বেরিয়ে পড়লেন মঠের বাইরে। এবারেও সঙ্গী স্বামী প্রেমানন্দ। প্রায় বেলুড় বাজার পর্যন্ত বেড়িয়ে এলেন; সচরাচর এতটা রাস্তা হাঁটতেন না। বিকেল পাঁচটা নাগাদ মঠে ফিরেই যেন চাঙ্গা হয়ে গেলেন স্বামীজি। কয়েকদিন ধরেই শরীরটা খারাপ যাচ্ছিল। কিন্তু এখন একেবারে ফিট! নিজের প্রিয় আমগাছটির তলায় বসে এমনটাই মনে হল তাঁর। সাতটার সন্ধ্যারতির পর নিজের ঘরে ঢুকলেন ধ্যান করতে। বাইরে রইলেন তাঁর সঙ্গী ব্রজেন্দ্র। অবশ্য বেলুড়ের সন্ন্যাসী-গুরুভাইদের কাছে তিনি ‘বাঙাল ব্রজেন্দ্র’ নামেই বেশি পরিচিত। বেশ কিছুক্ষণ পর ঘর থেকে সাড়া এল। গরম লাগছে ভীষণ, একটু জানলা খোলা দরকার। ব্রজেন্দ্র বিবেকানন্দের পা টিপে দিতে শুরু করলেন। 

এরকমভাবে বেশ কেটে গেল সময়। রাত ৯টার সময় থেকে একটু বদলে যেতে লাগল পরিবেশ। স্বামীজি বাঁপাশ ফিরে শুলেন; কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, মনে হল হাতটাও একটু কেঁপে উঠল। হঠাৎ কান্না। কিন্তু কেন? কোনো উত্তর নেই। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলতে লাগলেন স্বামীজি। রাত ৯টা ১০। মাথা বালিশ থেকে পড়ে গেল। দেহ স্তব্ধ। চোখ স্থির, অথচ মুখে লেগে আছে এক অদ্ভুত হাসি। শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে জ্যোতি। তাহলে কি ভাবসমাধি হল? নাকি… ডাক্তার মহেন্দ্র মজুমদার এলেন বরানগর থেকে। স্বামী ব্রহ্মানন্দ, সারদানন্দ, প্রেমানন্দ স্থিরদৃষ্টিতে দেখছেন তাঁদের প্রিয় নরেনকে। ডাক্তার নাড়ি দেখলেন; সবরকম চেষ্টা করে দেখলেন। কিছুই হল না। দিনটা ছিল ৪ জুলাই, ১৯০২ সাল, শুক্রবার। স্তব্ধ হলেন স্বামী বিবেকানন্দ। পড়ে থাকল তাঁর পার্থিব নিথর দেহ… 

খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। গঙ্গা পেরিয়ে পৌঁছল কলকাতাতেও। রাতটুকু কাটার অপেক্ষা শুধু। সকাল হতে না হতেই একে একে উপস্থিত হলেন সবাই। সবার আগে চলে এলেন ভগিনী নিবেদিতা। তাঁর গুরু, তাঁর ভগবান আর নেই, এই কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। এত তাড়াতাড়ি কি চলে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর! স্বামীজির মরদেহের পাশে বসে একটানা পাখার হাওয়া করে চললেন। স্বামীজির চোখদুটো লাল, নাক আর মুখ দিয়ে অল্প একটু রক্তও যেন বেরিয়েছে। নিবেদিতা ভাবছিলেন পুরনো দিনগুলোর কথা। নিজের পরিবার ছেড়ে ভারতে আসা, এখানে আরও এক পরিবার পাওয়া; সর্বোপরি স্বামী বিবেকানন্দকে গুরু হিসেবে পাওয়া। শেষের কয়েকদিন বেলুড় থেকে একটু দূরেই ছিলেন ভগিনী। নানাবিধ কারণ তাঁর; এমন মুহূর্তে সেসব মনে করতে নেই। 

আরও পড়ুন
‘পুরীর জগন্নাথ মন্দির আসলে একটি বৌদ্ধ মন্দির’ - বলেছিলেন বিবেকানন্দ, বুদ্ধের দন্তযাত্রার অনুকরণেই শুরু রথযাত্রা!

তবে মনে পড়ছিল দুটি ঘটনার কথা। মার্চ মাসে একদিন নিবেদিতাকে হঠাৎ করেই স্বামীজি বলেছিলেন, “আমার যা দেবার ছিল তা দিয়ে ফেলেছি, এখন আমাকে যেতেই হবে।” আরেকটি ঘটনা মৃত্যুর দুদিন আগে। ভগিনী নিবেদিতাকে বেলুড়ে নেমন্তন্ন করলেন স্বামী বিবেকানন্দ। পরম যত্নে তাঁকে খাইয়েছিলেন, তারপর হাত ধোয়ার জন্য নিজের হাতে জল ঢেলে দিয়েছিলেন। নিবেদিতা এসবের অর্থ প্রথমে বুঝতে পারেননি। স্বামীজির উত্তর, “তুমি যীশুর কথা পড়োনি? যীশু তাঁর শিষ্যদের পা ধুইয়ে দিয়েছিলেন।” কিন্তু সেটা তো মৃত্যুর আগে! কথাটা বলেই থেমে গিয়েছিলেন নিবেদিতা। এ কি বললেন তিনি! সেটাই ছিল শেষ সাক্ষাৎ। তারপরই ৫ জুলাইয়ের সকাল… 

আরও পড়ুন
‘দরকার হলে বেলুড় মঠের জমি বিক্রি করে দেব’, মহামারী রুখতে সংকল্প বিবেকানন্দের

একে একে উপস্থিত হলেন মা ভুবনেশ্বরী দেবী, ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখরা। গিরিশ ঘোষকে স্বামীজির মৃত্যুর খবর বলা হলে তাঁর একটাই বক্তব্য ছিল, “চলে যাননি, তিনি দেহত্যাগ করলেন।” সেই সূত্রেই মঠের গুরুভাইদের মনে পড়ছিল আরও কিছু কথা। মৃত্যুর মাত্র তিনদিন আগে বেলুড় মঠে ঘুরতে ঘুরতে একটা জায়গায় তাঁর চোখ গেল। সেখানে নির্দেশ করে স্বামীজি বলেছিলেন, “আমার দেহ গেলে ঐখানে সৎকার করবি।” 

আরও পড়ুন
স্ল্যাং-এর উদাহরণ রয়েছে রবীন্দ্রসাহিত্যেই, বাদ যাননি বঙ্কিম-শরৎ, এমনকি বিবেকানন্দও

এসব কি নেহাতই কাকতালীয়! মনে পড়ে, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব একবার বলেছিলেন, নরেন যবে বুঝতে পারবে তার কাজ সম্পন্ন হয়েছে, তখন সে নিজেই চলে যাবে। স্বয়ং বিবেকানন্দই বলেছিলেন, ৪০ বছরের আগেই তিনি চলে যাবেন। গেলেন ৩৯ বছর ৫ মাস বয়সে। সেই পূর্বনির্ধারিত স্থানে স্বামীজির চিতা জ্বলে ওঠার পর যেন এক নিমেষে শূন্য হয়ে গেল বেলুড়। তাঁর উজ্জ্বল মুখের ওপর চাপা দেওয়া হল কাঠ। ধীরে ধীরে কালো ধোঁয়া ঢেকে দিল আকাশ। সেই হাওয়াতেই মিলিয়ে গেলেন নরেন। গেলেন কি?… 

আরও পড়ুন
‘নতুন মাস্টার পড়াতে পারেন না’, শুনে বিবেকানন্দ-কে চাকরি থেকে বরখাস্ত বিদ্যাসাগরের

তথ্যসূত্র- অচেনা অজানা বিবেকানন্দ/ শংকর

আরও পড়ুন
ক্ষুদিরামকে নিয়ে সিনেমা, তথ্যের যোগান দিলেন বিবেকানন্দ ও অরবিন্দের বিপ্লবী ভাইয়েরা

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
কুড়ি রানে ৭ উইকেট নিয়েছিলেন বিবেকানন্দ, বাংলার ‘ডব্লিউ জি গ্রেস’ বলা হত উপেন্দ্রকিশোরের দাদাকে

More From Author See More