অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে পৌঁছেছেন কলকাতায়। কোনো রকমে মিলেছে মাথা গোঁজার ঠাঁই। সারাদিনের পরিশ্রম শেষে রাতে পড়তে বসলেই চোখে নেমে আসে যত রাজ্যের ঘুম। পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে প্রদীপের তেল কেনার সামর্থ্য পর্যন্ত নেই। তাই ছোট্ট ঈশ্বরচন্দ্র রাস্তার গ্যাসের আলোয় শুরু করলেন পড়াশোনা। আর এভাবেই তিনি হয়ে উঠলেন ‘বিদ্যাসাগর’। আরেকটি গল্প— তিনি তখন প্রতিষ্ঠিত। গ্রাম থেকে ডাক এসেছে মায়ের। মাতৃভক্ত সন্তানের পক্ষে অগ্রাহ্য করা অসম্ভব সেই ডাক। কিন্তু ভরা বর্ষার উন্মাদ দামোদর নদ পার হওয়ার উপায় কি? শেষ পর্যন্ত, মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে সাঁতার কেটে তিনি পৌঁছোলেন মায়ের কাছে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে (Ishwar Chandra Vidyasagar) নিয়ে এরকম প্রচলিত গল্পের অভাব নেই। যার কিছু গল্প সত্যি হলেও, অনেকগুলিই অতিরিক্ত রঙে ডোবানো। তার সত্যি-মিথ্যা নিয়ে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, কিন্তু অতিকথনের বাড়বাড়ন্ত তাঁকে একপ্রকার ‘অতিমানব’ করে তুলেছে বললে ভুল হয় না। কীভাবে যে এই গল্পগুলোর সূত্রপাত, তাও সম্ভবত জানা যাবে না আর। নিশ্চয়ই উদ্দেশ্য মহৎ ছিল। তাঁর মতো মানুষকে নিয়ে গল্প করতে বসলে শ্রদ্ধার মাপকাঠি গুলিয়ে ফেলাও স্বাভাবিক। কিন্তু, এইসব গল্প কি আদৌ সাহায্য করেছে বিদ্যাসাগরের কীর্তির মূল্যায়নে? নাকি তাঁর কর্মের আলাপ-আলোচনার থেকেও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে এই ‘অতিমানব’ সত্তা?
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এই গল্পগুলির মধ্যে জীবন সম্পর্কে শিক্ষা লুকিয়ে আছে। ল্যাম্পপোস্টের গল্পে তাঁর পড়াশোনার প্রতি ভালোবাসা ও একাগ্রতা। কিংবা দামোদর সাঁতরানোর গল্পে মাতৃভক্তির মতো পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিষয়। শিশুপাঠ্য কাহিনি পর্যন্ত ঠিক আছে, তবে তার সাহায্যে ‘ব্যক্তি’ বিদ্যাসাগরের জীবন নির্মাণ করতে গেলে মুশকিল। আর সেটা করতে গিয়েই অনেকক্ষেত্রে পিছনের সারিতে চলে যায় তাঁর বিরাট কর্মযজ্ঞের শিক্ষা। বিধবাবিবাহ ও স্ত্রীশিক্ষা প্রচলন, বঙ্গদেশ ঘুরে স্কুল তৈরি করা কিংবা ‘বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী’ হওয়ার সুফল তো আজও পাচ্ছি। ইতিহাসের সঙ্গেই বয়ে এসেছে তার গতিপথ। আবার, মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠার মতো একটা ঘটনা দামোদর সাঁতরে পার হওয়ার থেকেও কম বড়ো কাজ নয়।
১৮৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন। যার আজকের নাম ‘বিদ্যাসাগর কলেজ’। সেদিন কিন্তু ‘দানবীর’ লোক কলকাতায় কম ছিলেন না। নিজেদের পয়সায় স্কুলও খুলেছিলেন অনেকেই। তাহলে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের গুরুত্ব কি? উত্তর জানা যাক রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে,
“বাঙালির নিজের চেষ্টায় এবং নিজের অধীনে উচ্চতর শিক্ষার কলেজ-স্থাপন এই প্রথম। আমাদের দেশে ইংরাজি শিক্ষাকে স্বাধীনভাবে স্থায়ী করিবার এই প্রথম ভিত্তি বিদ্যাসাগর-কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হইল।”
এই পুরো উদ্ধৃতিটির মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক লাগে ‘স্বাধীনভাবে’ শব্দটি। বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত জ্ঞান সত্যিই সমুদ্রের সমান, তবু তিনি হাত লাগালেন ইংরেজি শিক্ষার কলেজ প্রতিষ্ঠায়। সমস্ত বন্দোবস্ত করেছিলেন প্রায় একা হাতে। এবং সেটাও কোনো ইংরেজ প্রতিষ্ঠানের ছায়ার বাইরে। প্রফুল্লচন্দ্র রায় যাকে বলছেন ‘জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’। তবে পরীক্ষা দিয়ে সার্টিফিকেটের জন্য তো কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দরকার। তখনই আসল অগ্নিপরীক্ষা। সেদিন সাফল্যের সঙ্গে পরীক্ষায় পাশ করে কলেজের মুখ রেখেছিল ছাত্ররা।
আরও পড়ুন
বিদ্যাসাগরের জন্মদিনই হোক ‘শিক্ষক দিবস’, কী ভাবছেন বিশিষ্টজনেরা?
রবীন্দ্রনাথের যখন এই প্রবন্ধ লিখেছেন, শান্তিনিকেতনের ছাতিমতলায় বসে শিক্ষা দেওয়ার দিন তখনও শুরু হয়নি। চলছে শিক্ষার আদানপ্রদান নিয়ে ভাবনাচিন্তা। নিজে কখনও প্রাতিষ্ঠানিক মাধ্যম থেকে শিক্ষালাভ করেননি, অথচ ‘বিশ্বভারতী’-তে মিশে গেছিল তাঁর বিশ্বমানবের চেতনা। মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের সঙ্গে তেলে-জলে মিশিয়ে ফেলা হয়তো ঠিক হবে না, কিন্তু ‘ইংরেজি’ শিক্ষা নিয়েও যে ‘জাতীয়’ ভাবধারা বজায় রাখা যায়, তার প্রমাণ পাওয়া গেছিল হাতেকলমে। স্বদেশি ও পরে গান্ধীজির ‘বয়কট’ আন্দোলনের সময়ে বাকি কলেজগুলির মাথায় হাত পড়লেও, নিশ্চিন্তেই ছিল বিদ্যাসাগর কলেজ। তিনি তখন পৃথিবীতে নেই, কিন্তু রয়ে গেছিল বিদ্যাসাগরের আদর্শ।
আরও পড়ুন
বিরোধীরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, ‘গণতান্ত্রিক’ পথেই জয় এনেছিলেন বিদ্যাসাগর
সেই আদর্শ যে বহন করা সম্ভব হয়নি, সেটা আর নতুন করে বলতে হবে না। তবু, সেদিন একক মানুষের সাহস, সদিচ্ছা, একাগ্রতায় স্তম্ভিত হয়েছিলেন ইংরেজরাও। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যখন নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ করছেন, তখন সমস্যার মুখে পড়ে যায় ইংরেজি বিভাগ। সেদিন বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, “যদি সুরেন্দ্র না হলে কলেজ না চলে, তাহলে বলতে হবে আমি কেউ নই। আমি তাহলে মরে গেছি।” ল্যাম্পপোস্টের গ্যাসের আলোয় পড়াশোনা করা ছেলেটির থেকে কোন অংশে কম এই জেদ আর আত্মবিশ্বাস? তারপরেও আমরা আঁকড়ে ধরে থাকি সেই গল্পগুলিকেই। হয়তো তাঁর মহত্ত্বকে অনুসরণ করা সম্ভব নয় বলেই।
আসলে, বীরপূজার দেশ ভারত। বহু উপচারে পূজা না করলে ঠিক মন ভরে না। ফুল-মালা ছাড়াও নৈবেদ্য হিসেবে দিতে হয় দুয়েকটা গল্প। মানব থেকে মহামানব হয়ে ‘ঠাকুর’-এ পৌঁছে শেষ হয় যাত্রাপথ। তাছাড়া ‘যিনি দরিদ্র ছিলেন, তিনি দেশের প্রধান দাতা হইলেন’—এই গল্প শুনতে ভালো লাগে সবারই। তাতে বাকি কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা কম হলে ক্ষতি কী? শিক্ষা ও সমাজকে বদলে দেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতেও তো প্রয়োজন দীর্ঘ প্রচেষ্টা। কিছুতেই সেটা অর্জন করতে দিচ্ছে না পরিবেশ, দায়ী নিজেরাও। আর সেভাবেই চলে এসেছে গল্পগুলো।
কলেজ প্রতিষ্ঠার কাহিনি সেখানে একটা বিচ্ছিন্ন উদাহরণমাত্র। তাঁর সারা জীবন জুড়েই ছড়িয়ে এরকম অজস্র কীর্তি। সেসব নিয়ে চর্চা করলেই দেখা যাবে আজকের সময়েও তিনি বহুভাবে প্রাসঙ্গিক। জন্মের দুশো বছর পরেও। আজও অব্যাহত রয়েছে তাঁকে নিয়ে চর্চা। প্রচলিত গল্পগুলিও থাক, কিন্তু সেটা যেন ছাপিয়ে না যায় তাঁর কৃতিত্বকে।
ঋণস্বীকার : করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, ইন্দ্র মিত্র
বিদ্যাসাগর চরিত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিদ্যাসাগর : নানা প্রসঙ্গ, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
Powered by Froala Editor