উনিশ শতকের শেষের দিক সেটা। এশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন কিংবদন্তি ব্রিটিশ অভিযাত্রী অ্যালফ্রেড আইজ্যাক মিডলটন (Alfred Isaac Middleton)। লক্ষ্য, চিনের তাকলামাকান এবং কুমতাগ মরুভূমির মাঝে লুকিয়ে থাকা এক স্বর্ণ-শহরের সন্ধান। হারিয়ে যাওয়া সেই প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করতে গিয়েই নিখোঁজ হয়েছিলেন স্যার আলফ্রেড আইজ্যাক মিডলটন। কিন্তু সত্যিই কি চিনের বুকে লুকিয়ে রয়েছে এমন একটি স্বর্ণশহর (Golden City)? কোথা থেকেই বা এই শহরের কথা জানতে পেরেছিলেন তিনি?
হ্যাঁ, খুঁজে পাওয়া সাম্প্রতিক বেশ কিছু নথি ও তথ্য নির্দেশ দিচ্ছে তেমনটারই। চিনের বুকে সত্যিই নাকি অবস্থিত ছিল ‘ডাউলিতু’-খ্যাত এই প্রাচীন নগরী। এবং সেই নগরীতে পৌঁছেও গিয়েছিলেন স্যার মিডলটন।
শুরু থেকেই গল্পটা বলা যাক বরং। আদতে ডাউলিতু (Dawleetoo) নামের এই শহরের বর্ণনা রয়েছে সুমাত্রার একটি লোককথায়। অভিযাত্রী মিডলটনও একাধিকবার সুমাত্রার জঙ্গলে হাজির হয়েছিলেন গুপ্তধন এবং প্রাচীন সভ্যতার সন্ধানে। সেখানে গিয়েই তিনি জানতে পেরেছিলেন চিনের এই হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন নগরীর কাহিনি। সুমাত্রার লোককথা অনুযায়ী, তাকলামাকান এবং কুমতাগ মরুভূমির মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত লবণাক্ত হ্রদ লোপ নুরের ধারেই নাকি রয়েছে এই গোপন শহর। বলাই বাহুল্য, এই গুপ্তধন বার করতে চিনে পাড়ি জমান মিডলটন। তারপর ঠিক কী হয়েছিল, এতদিন জানা ছিল না কারোরই। আজও নেই। তবে বেশ কিছু ছবি ও নথি এবার ইঙ্গিত দিল ডাউলিতুর সেই শহর নাকি সত্যিই খুঁজে পেয়েছিলেন মিডলটন। কিন্তু কীভাবে সন্ধান মিলল এই নথিগুলির?
মজার বিষয় হল, এই রহস্যের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছেন সাহিত্যজগতের প্রখরতম গোয়েন্দা শার্লক হোমসের স্রষ্টা স্যার আর্থার কোনান ডয়েল। আর্থারের এক প্রাক্তন সহকারী ও অভিযাত্রী স্যার জন মরিসের কাছেই সংরক্ষিত ছিল মিডলটনের বেশ কিছু নথি। আর সেই নথি প্রকাশিতও হয়েছিল একটি প্রাচীন স্মিথসোনিয়ান পত্রিকায়। সেই পত্রিকার পুনরাবিষ্কৃত পাতাই নতুন করে ঘনিয়ে তুলেছে জল্পনাকে।
আরও পড়ুন
পৃথিবীর বৃহত্তম গুপ্তধনের ভাণ্ডার! মাসখানেকেই মিলতে পারে হদিশ
আদতে ব্রিটিশ কনস্যুলেট থেকে একটি চিঠির অনুলিপি পাঠানো হয়েছিল কোনান ডয়েলের এই বন্ধুটিকে। সেখানেই উল্লেখিত হয় আইজ্যাক মিডলটন নামের এক ব্রিটিশ অনুসন্ধানকারীর নাম। দাবি করা হয়, জিনজিয়াংয়ের দক্ষিণ-পূর্ব অভিযানে গিয়ে ঘন অরণ্যে হারিয়ে যান তিনি। তবে লোপ নুর হ্রদের কাছে তিনি সন্ধান পেয়েছিলেন প্রাচীন নগরীটির। এমনকি সফলও হয়েছিলেন বেশ কিছু স্বর্ণ বিগ্রহ ও অলংকার নিয়ে আসতে। তবে কুলির অভাব হওয়ায়, ক্যাসকেটে করে এই ধনসম্পদ তিনি পুঁতে রাখেন মাটির তলায়।
আরও পড়ুন
গুপ্তধনের খোঁজে তালিবানরা; কী এই ব্যাক্ট্রিয়ান গোল্ড?
তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, অন্য একটি চিঠিতে উঠে আসে ভিন্ন একটি তথ্য। পথ হারিয়ে খাদ্যের অভাবে মৃত্যু হয়নি মিডলটনের। বরং, তিনি প্রাণ হারিয়েছিলেন বন্দি অবস্থায়। লোপ নুরের অরণ্যে তাঁর বাহিনীকে হানা করেছিল একদল দুষ্কৃতি। তাঁরাই বন্দি করেন মিডলটনকে। বন্দি অবস্থাতেই মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। অন্যদিকে তাঁর দলের কিছু মানুষ প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন সেখান থেকে পালিয়ে।
আরও পড়ুন
পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের ঢিলছোঁড়া দূরত্বে গুপ্তধন? খননে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ
পরবর্তীতে এই একই পথে ফের নতুন দল নিয়ে অভিযান চালান জন হারগ্রিভস নামে এক ব্যক্তি। আদতে যিনি ছিলেন মিডলটনের মিশনের দ্বিতীয় কম্যান্ড। অবশ্য গুপ্তধন পুনরুদ্ধারের চেষ্টা ব্যর্থ হয় তাঁর। অনেক অনুসন্ধান করেও খালি হাতেই ফিরতে হয়েছিল তাঁকে। তবে মজার বিষয় হল, হারানো নগরীর সন্ধান করেননি হারগ্রিভস। বরং, তন্ন তন্ন করে তিনি পুঁতে রাখা ক্যাসকেটের অনুসন্ধান করেছিলেন লোপ নুরের অরণ্যে।
সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট নথি এবং জন হারগ্রিভসের দ্বিতীয়বার অভিযানের কথা প্রকাশ্যে আসতেই আরও একবার চর্চায় উঠে এসেছে ডাউলিতু-র কথা। প্রশ্ন উঠছে, তবে কি সত্যিই লুকিয়ে রয়েছে এমন কোনো নগরী, যার সন্ধান পেয়েছিলেন মিডলটন। এই প্রসঙ্গে প্রকাশ্যে এসেছে বেশ কিছু ছবিও। অবশ্য সেগুলির সঙ্গে মিডলটনের অভিযানের কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ, তখনও পর্যন্ত ক্যামেরার চল বাড়েনি সেভাবে। তবে সে যাই হোক, এমন একটি শহরের সন্ধান যদি আজ মেলে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার নেই কিছুই। কারণ, একুশ শতকে দাঁড়িয়েও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তেই সন্ধান মিলছে নানান প্রত্নসামগ্রী, প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষের। তবে ‘ডাউলিতু’ রহস্যকে স্রেফ প্রতারণা বলেই মনে করেছেন অধিকাংশ ঐতিহাসিক…
Powered by Froala Editor