আজও আমাদের এই বাংলার সংস্কৃতির পরতে পরতে মিশে আছেন রাইকিশোরী। আমাদের রবি ঠাকুর ভানুসিংহের পদে লেখেন ‘জয় জয় রাধা’। অবন ঠাকুর আঁকেন রাই-কানুর রাসলীলার পট। মান্না দে থেকে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, তাবড় তাবড় গাইয়েরা একজোটে রেকর্ড করেন গীতিনাট্য- 'শ্রীরাধার মানভঞ্জন'। এখনও শান্তিপুরের রাস উৎসবে প্রতি বছর ছোট্ট মেয়েদের ফুলের গয়নার মুড়ে সাজানো হয় রাধারাণীর বেশে। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র রাইকিশোরীকে নিয়ে কী ভেবেছেন, কী লিখেছেন? একটু আলোচনা হোক!
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হিন্দুত্বের একটা নতুন ধারণা তৈরি করতে সচেষ্ট ছিলেন, আর এই নব্য হিন্দুয়ানির কেন্দ্রে তিনি রেখেছিলেন কৃষ্ণকে। পশ্চিমের পণ্ডিতদের কাছে কৃষ্ণকে আদর্শ মানুষ হিসাবে উপস্থাপন করার জন্য তিনি লিখলেন 'কৃষ্ণচরিত্র'। সাহেবদের ভুরু কোঁচকাবার মতো যা কিছু উপাদান কৃষ্ণকথায় আছে, এই বইতে সেই সব কিছুকে একধার থেকে ‘প্রক্ষিপ্ত’ বলে উড়িয়ে দিলেন তিনি। কৃষ্ণের বহুবিবাহকে অস্বীকার করে তাঁকে রুক্মিণীর একনিষ্ঠ পতি বানাতে চাইলেন, এবং কৃষ্ণের বৃন্দাবনীয় পরকীয়া প্রেমলীলা, অর্থাৎ গোপীসঙ্গকে এক্কেবারে উড়িয়ে দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন। আশ্চর্যভাবে, নিজের বাসভবনে যিনি ‘রাধাবল্লভ’ বিগ্রহের সেবক, সেই বঙ্কিমচন্দ্রই, শ্রীরাধা চরিত্রটিকে অর্বাচীন প্রক্ষেপ বলে প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন।
শ্রীরাধা বিষয়ে বঙ্কিমের যুক্তিগুলি কীরকম ছিল, তার কয়েকটা নমুনা দেখে নিই। 'কৃষ্ণচরিত্র' বইয়ের 'শ্রীরাধা' অধ্যায়ে বঙ্কিম দৃঢ়স্বরে বলছেন, "ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণে আর জয়দেবের কাব্যে ভিন্ন কোন প্রাচীন গ্রন্থে রাধা নাই।" বঙ্কিমের এই কথাখানা একেবারে ভুল। স্কন্দপুরাণের বৈষ্ণবখণ্ড, ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ, মৎস্য পুরাণ, শিব পুরাণ- এই সমস্ত পুরাণে শ্রীরাধার উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া নারদপঞ্চরাত্র, গর্গসংহিতা, ঊর্দ্ধাম্নায় তন্ত্র, বৃহদগৌতমীয় তন্ত্র, সনৎকুমার সংহিতা- সর্বত্র রাইরাণীর উল্লেখ একেবারে স্পষ্ট। শাক্ত সম্প্রদায়ের দেবী ভাগবত পুরাণ, নীলতন্ত্র, রাধাতন্ত্র প্রভৃতি গ্রন্থেও শ্রীরাধার নাম পাওয়া যাবে। আর কাব্য? শ্রীচৈতন্যের জন্মের অনেক আগে সংকলিত 'সদুক্তিকর্ণামৃত' বইটিতে তো বিভিন্ন কবির লেখা রাধা-বিষয়ক শ্লোকের ছড়াছড়ি!
স্থানাভাব হেতু সমস্ত গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া এখানে সম্ভব হচ্ছে না। গৌড়ীয় গোস্বামী ও আচার্যগণের অতি প্রিয় পদ্মপুরাণ (যা থেকে তাঁরা মুহূর্মুহূ প্রমাণ-শ্লোক চয়ন করেছেন) একটি উদ্ধৃতি দেওয়া যাক, যা শ্রীচৈতন্যের বৃন্দাবনভ্রমণ তথা রাধাকুণ্ড দর্শন প্রসঙ্গে কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর 'চৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন:
যথা রাধা প্রিয়া বিষ্ণোর্তস্যা: কুণ্ডং প্রিয়ং তথা।
সর্বগোপীষু সৈবৈকা বিষ্ণোরত্যন্তবল্লভা।।
অর্থাৎ, রাধা যেমন কৃষ্ণের প্রিয়, তেমনই তাঁর কুণ্ডও কৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয়। সকল গোপীগণের মধ্যে শ্রীরাধাই কৃষ্ণের অত্যন্তবল্লভা বা প্রিয়তমা।
আরও পড়ুন
বঙ্কিমচন্দ্রের কলমেই রূপ পান ‘ভারতমাতা’, অবনীন্দ্রনাথ তুলিতে ধরলেন তাঁকে
এইবার, শ্রীরাধার নিত্য অধিষ্ঠানভূমি গোলোকধামের প্রসঙ্গ। গোলোক সম্বন্ধে বঙ্কিম কী বলেন? অবশ্যই, তিনি এক্ষেত্রেও প্রমাণ তোলেন একমাত্র ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ থেকে, এবং সটান বলে দেন,
"সেই গোপগোপীর বাসস্থান রাধাধিষ্ঠিত গোলোকধাম পূর্ব্বকবিদিগের বর্ণিত বৃন্দাবনের বজনিশ নকল।"
বঙ্কিম গোলোকের উল্লেখ কেবল ব্রহ্মবৈবর্ত্তেই দেখলেন, বা দেখালেন, অন্যত্র কোথাও নয়। ভাগবত, পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মসংহিতা, গর্গসংহিতা, হরিবংশ- ইত্যাদি গ্রন্থের গোলোক-প্রসঙ্গ তিনি বেমালুম চেপে গেলেন। আচ্ছা বেশ, ভাগবতে উল্লিখিত গোলোকই যে বৈকুন্ঠশিরোরত্ন গোলোক, এই ব্যাখ্যাকে বঙ্কিম গৌড়ীয় গোস্বামীদের আধুনিক ব্যাখ্যা বলে দেগে দিতে পারেন, ব্রহ্মসংহিতা ও গর্গসংহিতা বইদুটির প্রাচীনত্বও তিনি অস্বীকার করতে পারেন, কিন্তু পদ্মপুরাণ? পদ্মপুরাণে, পাতালখণ্ডের ৩৮ নং অধ্যায়ে যে স্পষ্ট বলা হচ্ছে, "গোলোকৈশ্বর্যং যৎকিঞ্চিৎ গোকুলং তৎ প্রতিষ্ঠিতং" অর্থাৎ গোলোকের যা কিছু ঐশ্বর্য, তা গোকুলে ( আমাদের এই ধরণীর কৃষ্ণলীলাস্থলীতে) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; এবং এই গোলোককে পরম রহস্যময়, পরম গোপনীয়, "সাত্ত্বতাং স্থানমূর্ধণ্যম্" অর্থাৎ সকল বৈষ্ণবধামের শিরোরত্ন বলা হয়েছে। বঙ্কিমের অতিশয় প্রিয় হরিবংশের বিষ্ণুপর্বের অন্তর্ভুক্ত ৭৫ অধ্যায়তেও যে আছে, ব্রহ্মলোকেরও ঊর্দ্ধস্থিত সর্বব্যাপ্ত 'গোলোক'-এর কথা!
আরও পড়ুন
নিজের কবিতার বইয়ের বিজ্ঞাপন লিখলেন বঙ্কিমচন্দ্র, সেই প্রথম গদ্য লেখা তাঁর
বঙ্কিম এসব কোনও প্রমাণকেই, তাঁর অভ্যাস মতো 'প্রক্ষিপ্ত' বলে দেগে দেওয়ার কোনও চেষ্টা তো করলেনই না, এমনকি উল্লেখ পর্যন্ত করলেন না। কেবল ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণের গোলোক-বর্ণনাকে বাংলার যাত্রাপালার সংস্কৃতায়িত সংস্করণ বলে খানিকটা রসিকতা করে নিয়ে, তিনি প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলেন। কীই বা বলা যায়!
এইবার, শ্রীরাধার দার্শনিক তত্ত্ব সম্পর্কে বঙ্কিম কী বলেছেন দেখা যাক।
"সাংখ্যের প্রকৃতি তন্ত্রে শক্তিতে পরিণত হইয়াছিল। প্রকৃতিবাদ এবং শক্তিবাদে প্রভেদ এই যে, প্রকৃতি পুরুষ হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন।... কিন্তু শক্তির সঙ্গে আত্মার সম্বন্ধ এই যে, আত্মাই শক্তির আধার। যেমন আধার হইতে আধেয় ভিন্ন হইয়া থাকিতে পারে না, তেমনই আত্মা ও শক্তিতে পার্থক্য নাই। এই শক্তিবাদ যে কেবল তন্ত্রেই আছে, এমত নহে। বৈষ্ণব পৌরাণিকেরাও সাঙখ্যের প্রকৃতিকে বৈষ্ণবী শক্তিতে পরিণত করিয়াছেন।"
আরও পড়ুন
স্ল্যাং-এর উদাহরণ রয়েছে রবীন্দ্রসাহিত্যেই, বাদ যাননি বঙ্কিম-শরৎ, এমনকি বিবেকানন্দও
অর্থাৎ বঙ্কিমের মত হচ্ছে, নিরীশ্বর সাংখ্যদর্শনের 'প্রকৃতি'-তত্ত্বই ক্রমবিবর্তনের ফলে তন্ত্রে তান্ত্রিকী শক্তি এবং পুরাণে বৈষ্ণবী শক্তি (যেমন, বিষ্ণু ও ব্রহ্মবৈবর্ত্ত)- এই দুই প্রকার 'শক্তি'-তত্ত্বের রূপ পেয়েছে। আশ্চর্য, বঙ্কিম কি শক্তিতত্ত্বের মূল অনুসন্ধান করার সময় শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের কথা বেমালুম ভুলে গেলেন? সেখানে ঋষিগণ আদিতম জগৎকারণ অনুসন্ধান করতে করতে ধ্যাননেত্রে যা দেখেছিলেন, তা উপনিষদের ভাষায় "দেবাত্মশক্তিম্" (১/৩), অর্থাৎ পরমদেবতার আত্মশক্তি। একবচনের ব্যবহার বুঝিয়ে দেয়, এখানে সেই পরমদেবতার আত্মস্বরূপ ও শক্তিস্বরূপ এক ও অভিন্ন। ঠিক যেমনটা বঙ্কিম একটু আগে বলছিলেন, "আত্মাই শক্তির আধার... আত্মা ও শক্তিতে পার্থক্য নাই।" এবং, এই একই শক্তির বিবিধরূপে প্রকাশের তত্ত্বটিও উক্ত উপনিষদেই রয়েছে- "পরস্য শক্তির্বিবিধৈব শ্রূয়তে স্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্রিয়া চ" (৬/৮) ইত্যাদি। তা, এই শক্তিতত্ত্ব যখন শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেই রয়েছে, তখন একে নিরীশ্বর সাংখ্যদর্শনের প্রকৃতিতত্ত্বের ক্রমবিবর্তিত রূপ বলে চিহ্নিত করা কি আদৌ যুক্তিসিদ্ধ? বঙ্কিম আরও বলছেন, "বেদান্তে যাহা মায়াবাদ সাঙখ্যে তাহা প্রকৃতিবাদ। প্রকৃতি হইতে শক্তিবাদ।" অথচ শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেই "মায়াং তু প্রকৃতিং বিদ্ধি" (৪/১০) বাক্যে মায়া ও প্রকৃতির ঐক্য সূচীত, আর ঔপনিষদিক শক্তিতত্ত্বের কথা তো এক্ষুনি বলা হলো। সেক্ষেত্রে, মায়া > প্রকৃতি > শক্তি- কালভেদে ও গ্রন্থভেদে এই তাত্ত্বিক ক্রমবিবর্তনের কল্পনা, দর্শনচর্চার ইতিহাস থেকে সরে যাচ্ছে, তাই না?
এরপর, শ্রীতত্ত্ব। বঙ্কিমের মতে বিষ্ণুপুরাণে বর্ণিত বিষ্ণুশক্তি শ্রীতত্ত্ব, সেই একইভাবে, নিরীশ্বর সাংখ্যের প্রকৃতিতত্ত্বের বিবর্তনের ফল। এখানেও বঙ্কিম, সুকৌশলে একটা তথ্য এড়িয়ে গেলেন। তথ্যটি কী? বেদের অতি বিখ্যাত 'শ্রীসূক্ত' প্রসঙ্গ। তাতে শ্রী-নাম্নী দেবতা বহু পূর্বেই পরমেশ্বরীরূপে বন্দিতা। শ্রীসূক্ত, আসমুদ্রহিমাচলে বিখ্যাত, বন্দিত, নন্দিত। বঙ্কিম এ কথা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে, বিষ্ণুপুরাণেই শ্রীতত্ত্বের মূল চিহ্নিত করলেন, এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের রাধাতত্ত্বকেও ওই একই তত্ত্বের ঈষৎ পরিবর্তিত রূপ বলে দেগে দিলেন।
অর্থাৎ, শ্রীরাধার দার্শনিক তত্ত্ব বর্ণনার ক্ষেত্রেও বঙ্কিম অতিশয় কূটকৌশলে তথ্য গোপনের মাধ্যমে অপূর্ব বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন!
সব মিলিয়ে, কী ইতিহাস, কী সাহিত্য, কী দর্শন- সর্বক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র যেভাবে রাধাতত্ত্ব বিষয়ক অপসিদ্ধান্ত প্রচার করলেন, সেইরকম অসামান্য বৌদ্ধিক কারচুপি বঙ্গীয় বিদ্যাচর্চার জগতে খুব বেশি নেই বললেই হয়!
এইবার, ভাগবতাদি প্রাচীন গ্রন্থ থেকে শ্রীরাধাতত্ত্ব সম্পর্কে অল্প কিছু কথা বলা যাক। ভাগবতের রাসপঞ্চাধ্যায়ে ‘রাধিত’ পদ কৃষ্ণকে সূচীত করে, এটি "হরিঃ" শব্দেরই বিশেষণ। "রাধিত" পদের একটি একটি ব্যাখ্যা 'আরাধিত'। আরেক ব্যাখ্যা, "যিনি রাধাকে পেয়েছেন"।
বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর সারার্থদর্শিনী টীকায় 'রাধিত' শব্দের ব্যাখ্যা - "রাধাং ইত: (প্রাপ্ত:) - রাধিত: শকন্ধাদিত্বাৎ পররূপম্।" ভাগবতের ওই অধ্যায়েই (১০/৩০/৩৪) কৃষ্ণ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, "রেমে তয়া চাত্মরত আত্মারামো'প্যখণ্ডিতঃ"। অর্থাৎ,
কৃষ্ণ আত্মরত, আত্মারাম, অখণ্ডিত, অথচ তিনি রাধার সঙ্গে রমণ করলেন। অর্থাৎ রাধা কৃষ্ণের আত্মস্বরূপ ভিন্ন অন্য কেউ নন। এখানেই রাধা ও কৃষ্ণের পরম একত্ব সূচীত হল। এর সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে হবে স্কন্দপুরাণধৃত শ্লোক, "আত্মা তু রাধিকা তস্য" (রাধিকাই হচ্ছেন কৃষ্ণের আত্মা) এবং "স এব সা স সৈবাস্তি" (কৃষ্ণই রাধা, রাধাই কৃষ্ণ)। এর সঙ্গে একবাক্যতা ঘটবে চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থধৃত, কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী বর্ণিত রাধাতত্ত্ব বিষয়ক পংক্তিগুলির,
"রাধা পূর্ণশক্তি কৃষ্ণ পূর্ণশক্তিমান।
দুই বস্তুতে ভেদ নাহি শাস্ত্রের প্রমাণ।।
মৃগমদ তার গন্ধ যৈছে অবিচ্ছেদ।
অগ্নি জ্বালাতে যৈছে নাহি কভু ভেদ।।
তৈছে রাধাকৃষ্ণ সদা একই স্বরূপ।
লীলারস আস্বাদিতে ধরে দুই রূপ।"
পদ্মপুরাণে শ্রীরাধাকে বলা হয়েছে, "প্রকৃতিস্ত্বাদ্যা রাধিকা" অর্থাৎ শ্রীরাধাই আদ্যা প্রকৃতিতত্ত্ব; তাঁকে বলা হয়েছে "মায়েশ্বরি মহাপ্রভে", অর্থাৎ মহাপ্রভাময়ী, মায়াতত্ত্ব্বের অধীশ্বরী তিনি। নারদ তাঁর স্তব করে বলেছেন, "ইচ্ছাশক্তির্জ্ঞানশক্তি: ক্রিয়াশক্তিস্তবেশিতুঃ। তবাংশমাত্রমিত্যেবং মনীষা মে প্রবর্ত্ততে।।" অর্থাৎ ইচ্ছাশক্তি, জ্ঞানশক্তি ও ক্রিয়াশক্তির উপরে ঈশিত্ব বা প্রভুত্বের অধিকারিণী শ্রীরাধা। শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধা সম্পর্কে বলেছেন, "মমেষ্টা হি সদা রাধা", শ্রীরাধাই সদাসর্বদা আমার ইষ্টদেবতা। এবং, রাধা স্বয়ং নারদকে আত্মমহিমা বর্ণনা করার সময় বলেছেন "অহঞ্চ ললিতা দেবী পুংরূপা কৃষ্ণবিগ্রহা। আবয়োরন্তরং নাস্তি সত্যং সত্যং হি নারদ।।" অর্থাৎ, আমিই ললিতা দেবী, এবং পুংরূপে আমিই কৃষ্ণ, আমাদের মধ্যে কোনও ভেদ নেই - হে নারদ, এ কথা সত্য, এ কথা সত্য। দার্শনিক বিচারে, শ্রীললিতা প্রত্যভিজ্ঞা দর্শন-জাত শাক্তাদ্বৈতবাদের পরম "পূর্ণাহং" তত্ত্বমূর্তি, এবং শ্রীকৃষ্ণ অচিন্ত্যভেদাভেদবাদের পরম "ভগবান্ স্বয়ম্" তত্ত্বমূর্তি। উভয় তত্ত্বই শ্রীরাধায় সুসমঞ্জসরূপে সমাশ্রিত।
অতএব, কৃষ্ণদাস কবিরাজের প্রতিধ্বনি করে বলতে হয়, ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রে শ্রীরাধা হলেন "সর্বপূজ্যা পরমদেবতা", তিনি "সমস্তের পরা ঠাকুরাণী", সর্বতত্ত্বশিরোমণি পরমতত্ত্ব।
বঙ্কিমচন্দ্র যাই বলুন, আমরা কিন্তু রাইকিশোরীকে ছাড়িনি। কেবল মন্দিরের পূজাবেদিতেই নয়, বাঙালির গানে গল্পে কবিতায় নাটকে ছবিতে- শ্রীরাধা কোথায় নেই? আজও রাধা আছেন, রাধা থাকবেন বাঙালির সবখানে, সবটুকু জুড়ে।
উল্লেখ্য গ্রন্থপঞ্জী:
১. বঙ্কিম রচনাবলী (২য় খণ্ড), সাহিত্য সংসদ।
২. শ্রীমদ্ভাগবত (এবং বিশ্বনাথ চক্রবর্তী কৃত সারার্থদর্শিনী টীকা)
৩. পদ্মপুরাণ, পাতালখণ্ড।
৪. শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ।
৫. শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, কৃষ্ণদাস কবিরাজ বিরচিত।
Powered by Froala Editor