নরকরোটি, হাড় ও মদ - বাঙালির ভূতচতুর্দশীর ছোঁয়া 'ফুটবলের দেশ' ব্রাজিলেও

কালীপুজোর দিনটা যেমন আসে নিজস্ব মহিমা নিয়ে, তেমনই একটা নিজস্ব জায়গা নিয়ে আছে তার আগের দিনের চতুর্দশীটি। ছোটোবেলায় এই ভূত-চতুর্দশীর রাতে বাড়ির যে কোণে প্রদীপ নিভে গেছে, সেদিকে যেতে গা ছমছম করত। হাওয়ায় প্রদীপ নিভে গেলে পরিবারের বয়জ্যেষ্ঠ সদস্যা বলতেন - অতৃপ্ত আত্মা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিচ্ছে।

আসলে এ এমন এক দিন, যেদিন পরিবারের পরলোকগত ব্যক্তিদের স্মরণ করা হয়। গৃহস্থ-বাড়িতে চোদ্দ-প্রদীপ জ্বালানো হয়। অনেক পরিবারে এক একটি প্রদীপ উৎসর্গ করা হয় এক-একজন পরলোকগত সদস্যের উদ্দেশ্যে। কার্তিক মাসে জ্বলে 'আকাশ প্রদীপ'। মানুষ বিশ্বাস করে - তাঁরা যেখানেই থাকুন, এই প্রদীপের আলো তাঁদের আশ্বস্ত করবে যে পরিবার, সন্তান-সন্ততি তাঁদের ভোলেনি। দরজার মাঝে চোদ্দ-ফোঁটা দেওয়া হয়, সিঁদুর আর চন্দন দিয়ে। খাওয়া হয় চোদ্দ শাক - ১) ওল, ২) কেঁউ/কেও, ৩)নিম,  ৪) সর্ষে,  ৫) পলতা, ৬)কালকাসুন্দে , ৭) জয়ন্তী, ৮) শাঞ্চে, ৯) হিলঞ্চ, ১০) বেতো, ১১) শেলু, ১২) গুলঞ্চ, ১৩) ভাঁটপাতা, ১৪) শুষণীশাক। এমনকি, এই ভূত-চতুর্দশী নিয়ে মজার অথবা গা-ছমছমে গল্প একসময় ঘুরত পরিবারের সদস্যদের মুখে মুখে।

যদিও এই চোদ্দ-শাক খাওয়ার লোকাচার প্রায় চারশ বছর কি তারও বেশি প্রাচীন, কিন্তু এখন এত প্রজাতির শাক দেখেই বা ক'জন চিনবে আর চাইলেই বা পাচ্ছে কোথায়? পালং, কলমি, লাল শাক... ইত্যাদি সহজলভ্য কিছুর সঙ্গে আরও কিছু মিশিয়ে চোদ্দটা করাই বড় ব্যাপার।

তবে এই ভূত-চতুর্দশী সম্পর্কিত এত সংস্কার বা আচার-আচরণের মধ্যে যে মূল বিষয়, তা সেই একটিই - পরলোকগতদের স্মরণ। মহালয়ার তর্পনের থেকে আলাদা এই স্মরণ। এবং এভাবে চির-বিদায় নেওয়া নিকটব্যক্তির আত্মাকে স্মরণ করার লৌকিক আচার পৃথিবীর অনেক অংশে আছে। যার একটি হল - Dia de los Muertos (ডিয়া দে লস মুয়েরতস)।

মেক্সিকো, ব্রাজিল, পর্তুগাল আর স্পেনের কিছু অংশে, এমনকি ভারতের গোয়াতেও(এছাড়াও পৃথিবীর আরও অনেক দেশে) এই ডিয়া দে লস মুয়েরতস নামক দিনটি পালন করা হয়; যার অর্থ 'পরলোকগতদের দিবস'। পরিবারের পরলোকগতদের আত্মার শান্তি কামনা করে, তাঁদের স্মরণ করার জন্য একটি বিশেষ দিন। আর, তা পালন করা হয় ২রা নভেম্বর।

এটি অতি প্রাচীন একটি সামাজিক প্রথা, যা ক্রমে পালন করার মতো একটি বড় এবং বিশেষ উপলক্ষ হয়ে উঠেছে। ডিয়া দে লস মুয়েরতস দিনটির সঙ্গে যুক্ত সামাজিক আচার, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং এর গুরুত্বকে সম্মান জানিয়ে ২০০৮ সালে UNESCO এই উপলক্ষটিকে 'Representative List of the Intangible Cultural Heritage of Humanity'-র তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। বলা বাহুল্য, এই সামাজিক প্রথা পরলোকগতদের স্মরণ করে সম্মান জানানোর জন্যে একটি বিশেষ দিবস হলেও এখন তা একটি উৎসব, মানে একেবারে কার্নিভাল পর্যন্ত হয় মেক্সিকো অথবা ব্রাজিলের মতো দেশগুলিতে।

অনুমান করা হয়, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে থেকে এই সামাজিক প্রথা বহন করছেন সেই সব মানুষ, যাঁদের পূর্বপুরুষ দীর্ঘকাল লাতিন আমেরিকায় থেকেছে। পরলোকগত পূর্বপুরুষদের স্মরণ করার সামাজিক প্রথা, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, এইসব ঘিরেই এই দিনটি পালিত হত। প্রাচীন মেক্সিকান ক্যালেন্ডারে (Aztec) এই বিশেষ দিনের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই প্রাচীন সংস্কারে সব রকম আচার অনুষ্ঠান উৎসর্গ করা হ'ত মৃতজগতের দেবী 'La Calavera Catrina'-কে। মেক্সিকোতেই এই উৎসবের শেকড় বলে, এখনও উত্তর আমেরিকার টেক্সাস, অ্যারিজোনা, নিউ মেক্সিকো (যে অঞ্চলগুলিতে মেক্সিকান ভূমিপত্ররা বসবাস করেছে দীর্ঘকাল ধরে) প্রভৃতি অঞ্চলগুলিতে পরম্পরাগতভাবে থেকে গেছে এই প্রথা (মূলত উত্তর আমেরিকার প্রাচীন ভূমিসন্তানদের সংস্কৃতি বা লোকাচার)। প্রথম দিকে আগস্টের কাছাকাছি সময় এই দিনটি পালিত হলেও বিংশ শতাব্দীতে এসে ২রা নভেম্বার দিনটিই মেক্সিকোতে পালিত হতে থাকে Dia de los Muertos নামে। এবং ক্রমে অন্যান্য সব দেশেও এই দিনেই পালিত হতে শুরু করে পরলোকগতদের স্মরণ করার এই আচার, যা এখন উৎসব হয়ে গেছে।

এই দিনটিতে মানুষ গোরস্থানে গিয়ে পরলোকগত আত্মীয়পরিজনের সমাধির সামনে বসে তাঁদের স্মরণ করেন, এইটি প্রধান কাজ। সমাধিগুলো সুন্দর করে সাজানো হয় ফুল দিয়ে, মোমবাতি দিয়ে। কোথাও কোথাও দুঃস্থদের আহার বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়(পুণ্যকর্মে যাতে মৃতদের আত্মার মঙ্গল হয়)। এক ব্রাজিলীয় পরিচিত আমাকে বলেছিলেন ‘হ্যালুইনের সঙ্গে এই দিনটির তুলনা চলে না। ওরা শুধু মজা-আনন্দ করে এই দিনে। আমাদের তা নয়। জানি, এখন কার্নিভাল, খাওয়াদাওয়া সব হয়... কিন্তু দিনটা ঠিক আনন্দের নয়।’ হ্যাঁ, এখন Dia de los Muertos এর চেহারা অনেক পাল্টে গেছে, এই পরিবারের মানুষদের স্মরণ করার উপলক্ষকে কেন্দ্র করেই পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে আসে, ফ্যামিলি গেট টুগেদার এর মত হয়। খাওয়া-দাওয়া হয়। কেবল এই দিনটির জন্য বিশেষ কিছু খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত করা হয় - চিনির তৈরি নরকরোটি, হাড়ের মত দেখতে পাউরুটি, মদ এবং অ্যালকহলহীন কিছু বিশেষ পানীয়... এমন অনেক কিছু। দেশ এবং স্থানীয় সংস্কৃতির প্রভাবে উৎসব পালনের প্রথাও নিজস্বতা পায় বইকি! যেমন জামাইকাতে এক প্রকার আইস টি প্রস্তুত হয় জবাফুল আর জবাগাছের পাতার নির্যাস ব্যবহার করে... চুনির মত লাল ঠান্ডা চা। এ ছাড়া ব্রাজিল বা মেক্সিকো, যেখানে এই উৎসবটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে থাকে নানারকম মুখোশ, নানারকম সেজে পথে বেরোয় কার্নিভাল, মেলা, বিশাল আয়োজন!

Dia de los Muertos-এর কথা প্রথমবার জেনে, আমাদের ভূত চতুর্দশীর কথা মনে পড়ে গেছিল। লোকাচারের সময়টাও তো খুবই কাছাকাছি। ভূত বা ভৌতিক ছবি, জোক্‌স নিয়ে নানারকম কৌতুক এখন চললেও ছোটোবেলা দেখেছি বাড়িতে ঠাকুমা এবং মাকে বেশ যত্ন নিয়ে চোদ্দ প্রদীপের ব্যবস্থা করতে। সন্ধেবেলা প্রদীপ দেওয়ার সময় মা আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেত, প্রথম দিকের তিন-চারটি প্রদীপ নাম করে করে এক একজন পরলোকগত নিকটাত্মীয়কে স্মরণ করে রাখা হত। প্রথম দিকের কিছু প্রদীপ ছাদের পাঁচিলে এই ভাবে দক্ষিণ দিকে মুখ করে রাখার পর, অবশিষ্ট প্রদীপগুলো বাড়ির বিভিন্ন প্রান্তে রাখা হত। হয়ত এখনও অনেকেই কালীপুজোর আগে এই চতুর্দশীর রাতের এই আচারগুলি চিনতে পারবেন। একটা প্রজন্মের পর হয়ত অনেকেই পারবে না। ভূত চতুর্দশী হয়তো কখনও কার্নিভাল হতে পারবে না... কিন্তু এও তো একটি সমাজের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী একটি স্মৃতিবিজড়িত রীতি... হুশ করে তেনাদের মত বাতাসে মিলিয়ে না গেলেই হল!

Powered by Froala Editor

More From Author See More