মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন জার্মান খেলোয়াড়রা। এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ঘরজুড়ে। কেবলমাত্র হিটলারের কথা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দেওয়ালে দেওয়ালে। বেশ উত্তেজিত তাঁর কণ্ঠস্বর। পিছনে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন দুই নাৎসি আমলা জোসেফ গোয়েবলস এবং হ্যামলার। তাঁদের ডাকেই হুঁশ ফিরল হিটলারের। দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে মাঝারি চেহারার এক নেটিভ ভদ্রলোক। পরনে কোর্ট, সাদা প্যান্ট আর কেটস। ‘আমিই ভারতীয় দলের অধিনায়ক’, পরিচয় দিলেন তিনি। আড়চোখে আপাদমস্তক মেপে, এগিয়ে এসে করমর্দন করলেন হিটলার। শুভেচ্ছাবার্তা ফুটে উঠল তাঁর কথায়। তারপরই সরাসরি প্রস্তাব, জার্মানির নাগরিকত্ব গ্রহণের। জানালেন, মেজর পদও দেওয়া হবে তাঁকে নাৎসি বাহিনীতে। অথচ, এই ব্যক্তির সঙ্গে যে সামনাসামনি তাঁকে দেখা করতে হবে, তা দুঃস্বপ্নেও ভাবনি ফুয়েরার।
নতুন করে সেই ভারতীয় ব্যক্তির পরিচয় দেওয়ার দরকার নেই। হ্যাঁ, তিনি কিংবদন্তি ধ্যানচাঁদ। যাঁর একক নৈপুণ্যে ভর করে ১৯২৮, ১৯৩২ এবং ১৯৩৬-এর অলিম্পিকে সোনা এনেছিল ভারত। আর এই তিনটি অলিম্পিকে সব মিলিয়ে তিনি একাই করেছিলেন ৩৩টি গোল। যা একটা গোটা দলের কাছেও স্বপ্নাতীতই বটে। তবে ১৯৩৬-এর বার্লিন অলিম্পিকে মাঠে নামার আগেই তাঁর দুঃসাহস প্রত্যক্ষ করেছিলেন অ্যাডলফ হিটলার। অবাক হয়েছিল গোটা বিশ্ব!
’৩৬-এর বার্লিন অলিম্পিকের কোনায় কোনায় লুকিয়ে ছিল রাজনীতির চোরাস্রোত। জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতেই মরিয়ে উঠেছিলেন জার্মানির স্বৈরাচারী শাসক। আর অন্যদিকে জাতিগত অগ্রাসনের বিরুদ্ধে খেলার ময়দানকেই প্রতিবাদের মঞ্চ করে নিয়েছিল জেসি ওয়েনের আমেরিকা। অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সমস্ত দেশের প্রতিনিধিরা হিটলারকে স্যালুট জানালেও, বিরত ছিল আমেরিকানরা অ্যাথলিটরা। আর তা নিয়েই সাড়া পড়ে গিয়েছিল গোটা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে। তবে শুধুই কি আমেরিকা? সেদিন হিটলারকে স্যালুট করেননি ধ্যানচাঁদের নেতৃত্বাধীন ভারতের হকি দলও। তবে রাজনৈতিক কারণে নয়, বরং আবেগতাড়িত হয়েই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ধ্যানচাঁদ। বার্লিনে পৌঁছানোর পর থেকেই ভারতীয় দলকে খানিকটা নিচু চোখেই দেখে এসেছিল সেবারের অলিম্পিক আয়োজকরা। তাঁরা যে হতদরিদ্র এক দেশের প্রতিনিধি, যাঁদের স্বাধীনতাটুকুও নেই। এই মানসিকতারই প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ধ্যানচাঁদ।
আরও পড়ুন
ছেলেবেলার স্বপ্নপূরণ করতে এসে অলিম্পিকে সোনা গণিতের অধ্যাপকের
তবে শুধু প্রতিবাদই নয়, হকির ময়দানে দেশের রাজকীয়তা প্রতিষ্ঠার অন্য এক চ্যালেঞ্জ নিয়েও সেবার বার্লিনে নেমেছিলেন ধ্যানচাঁদ। অলিম্পিকের আসর বসার আগে থেকেই গোটা বিশ্ব জুড়েই চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল হকির ভারতীয় দল। তাঁরা যে বিগত দু’বারের অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন। আর অধিকাংশ দেশেরই বক্তব্য ছিল, যোগ্য দল না হওয়া সত্ত্বেও ১৯৩২-এর অলিম্পিকে বিনা-প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সোনা পেয়েছিল ভারত। কেন না, গ্রেট ডিপ্রেশনের কারণে সেবার অংশ নেয়নি অধিকাংশ ইউরোপিয় দেশ। পাশাপাশি বার্লিনে প্রস্তুতি ম্যাচে জার্মানির কাছে ৪-১ গোলে হার ভারতের। তা নিয়েই সরগরম হয়ে উঠেছিল ইউরোপিয় মিডিয়া। ‘ধ্যানচাঁদ-এর খেলা শেষ’, ফলাও করে ছাপা হয়েছিল অধিকাংশ সংবাদপত্রেই।
আরও পড়ুন
অলিম্পিকে তিনবার সোনাজয়ী, চলে গেলেন কিংবদন্তি হকি খেলোয়াড় বলবীর সিং
তাঁদের যে সেই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, তা অলিম্পিক শুরুর পরেই হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ধ্যানচাঁদ। হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে ৪-০ গোলে জয় দিয়েই শুরু হয়েছিল বার্লিন অভিযান। তারপর ভারতের কাছে একে একে বশ্যতা স্বীকার করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, জাপানের মতো শক্তিশালী দেশগুলি। তবে ইউরোপিয় সংবাদমাধ্যমের ভোল পাল্টে যায় ভারত সেমিফাইনালে ১০-১ গোলে ফ্রান্সকে পর্যুদস্ত করার পর। ছাপা হল, ‘অলিম্পিকের স্টেডিয়ামে শুরু হয়েছে ভারতের ম্যাজিক শো’। এমনকি খোদ হিটলারের শহরও ছেয়ে গেল পোস্টারে। ‘ভারতীয় ম্যাজিশিয়ান ধ্যানচাঁদের খেলা দেখতে আসুন হকি স্টেডিয়ামে’। হ্যাঁ, ফাইনালটা ছিল জার্মানির সঙ্গেই।
আরও পড়ুন
পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে দেশের মহিলা হকি প্লেয়াররা, জোগাড় করলেন ২০ লক্ষ টাকা
প্রথম অর্ধে ১-০ গোলে পিছিয়ে পড়লেও, দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ধ্যাঞ্চাঁদের হ্যাটট্রিকে এগিয়ে যায় ভারত। তারপর ক্রমশ বাড়তে থাকে গোলের ব্যবধান। ম্যাচের শেষে ফলাফল ছিল ৮-১। না, হিটলার শেষ পর্যন্ত দর্শাসনে ছিলেন না হিটলার। দ্বিতীয়ার্ধে ধ্যানচাঁদের তিন গোল দেখার পরেই মাঠ ছাড়েন তিনি। তারপর ম্যাচের চূড়ান্ত ফলাফল শোনার পর, ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাতের জন্য ভারতীয় অধিনায়ককে ডেকে পাঠিয়েছিলেন ফুয়েরার।
সেই সাক্ষাতের গল্প বলা হয়েছে একেবারে শুরুতেই। আর ধ্যানচাঁদের উত্তর? তা সহজেই অনুমেয়। হ্যাঁ, নাগরিকত্ব কিংবা মেজর পদে চাকরির প্রস্তাব একবাক্যেই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ম্যাজিশিয়ান। স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন ভারত ছেড়ে অন্য কোথাও যাবেন না তিনি। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে স্বল্প বেতনের কেরানির চাকরিই তাঁর সম্মানের পক্ষে যথেষ্ট। আশ্চর্যের বিষয় হল, ১৯৩৬ সালের সেই ঐতিহাসিক দিনটা ছিল ১৫ আগস্ট। এও যেন অদ্ভুত এক সমাপতনই বটে।
কিন্তু এহেন ব্যক্তিত্বকে জীবদ্দশায় কতটুকু সম্মান জানাতে পেরেছে ভারত সরকার? ১৯৫২ সালে পদ্মভূষণ পুরস্কার। ব্যাস। ওইটুকুই। শেষ বয়সে আর্থিক অনটনের সঙ্গে ক্রমশ লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে। সম্বল বলতে ছিল সামান্য পেনশন। নিজের জীবনের শেষ দিনগুলোতে হাসপাতালে শুয়েই আক্ষেপ করেছিলেন ধ্যানচাঁদ। দুঃখের সঙ্গেই জানিয়েছিলেন ভারতের হকির দিন শেষ। বর্তমান প্রজন্ম আর কসরত করতে আগ্রহী নয়। তাঁর সেই কথাই যেন ফলে গিয়েছিল খাতায়-কলমে। ৪১ বছর আর অলিম্পিকের সেমি-ফাইনাল খেলার সুযোগ জোটেনি ভারতের। সম্প্রতি, মহিলা এবং পুরুষ উভয় বিভাগেই হকির সেমি-ফাইনালে পৌঁছেছে ভারতীয় দল। আর ঐতিহাসিক এই মুহূর্তে বার বার যেন আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে বিস্মৃত সেই ম্যাজিশিয়ানের কথাই…
Powered by Froala Editor